হ্যারির বন্ধুবান্ধব এবং তার অধীন নিগ্রো মজুররা বার বার তাকে ওঝার সঙ্গে দেখা করে মিটমাট করতে উপদেশ দিল। কিন্তু হ্যারি তার সংকল্পে অটল, কিছুতেই তিনি ওঝার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন না।
হঠাৎ একদিন সকালে ওঝা নিজেই এল হ্যারির সঙ্গে দেখা করতে। ওঝার পোশাক পরিচ্ছদে অবশ্য যদি সেটাকে পরিচ্ছদ বলা যায় সত্যিই কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তার অধমাঙ্গের কিছু অংশ আবৃত করে ঝুলছে বাঁদরের চামড়া এবং উক্ত বানরচর্মের সঙ্গে সংলগ্ন হয়েছে মানুষের হাতের হাড়, কঙ্কাল-করোটি, শুষ্ক গিরগিটি প্রভৃতি বিচিত্র ও বীভৎস জন্তু।
পরস্পরের ভাষা বুঝতে যদি অসুবিধা হয়, সেজন্য হ্যারি তার নিগ্রো ভৃত্যকে ওঝার সামনে হাজির করলেন। ভৃত্যটি ওঝার সান্নিধ্য পছন্দ করেনি, কিন্তু প্রভুর আদেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হল।
অবশ্য কথাবার্তা বলতে বা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হল না। আফ্রিকায় প্রচলিত পিজিন ইংলিশ নামে অশুদ্ধ ইংরেজিতে কথোপকথন চলছিল।
হ্যারির জিজ্ঞাস্য হল, ওঝার জাদুবিদ্যা তাকে আফ্রিকার মাটি থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি কেন?
ওঝা জানাল, সে আশ্চর্য হয়েছে এবং সেইজন্যই সে মাসার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ওঝা আরও জানাল যে হ্যারির আঙুলের ক্ষত সে ভালো করে দিতে পারে, অবশ্য মাসা যদি তার সঙ্গে মিটমাট করতে সম্মত হয়।
হ্যারি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, তুমি জাদুবিদ্যার সাহায্যে আমাকে মারতে পারবে না। এমনকী অস্ত্রের সাহায্যেও তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না।
নিজের গুলিভরা রিভলভার তিনি ওঝার হাতে দিয়ে বললেন, যদি সাহস থাকে আমাকে গুলি করে মারো।
ওঝা রিভলভারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, তারপর অস্ত্রটাকে হ্যারির হাতে ফেরত দিয়ে জানাল, এত ছোটো বন্দুক ছুঁড়তে সে অভ্যস্ত নয়।
হ্যারি তৎক্ষণাৎ ভৃত্যকে তার রাইফেল নিয়ে আসতে আদেশ করলেন।
রাইফেল এল। ওঝা বলল, বন্দুক ছুঁড়তে তার ভালো লাগে না, সে তরবারি চালনা করতেই অভ্যস্ত।
নাছোড়বান্দা হ্যারি ভৃত্য পাঠিয়ে নিকটবর্তী এক সৈনিক বন্ধুর কাছ থেকে একটা আর্মি সোর্ড আনালেন এবং সেই তলোয়ারটা তুলে দিলেন ওঝার হাতে।
ওঝা অস্ত্রটার ধার পরীক্ষা করে শূন্যে দুই একবার তরবারি আস্ফালন করল, তারপর বলল, শ্বেতাঙ্গদের অস্ত্র সে ব্যবহার করতে পারবে না–অতএব এই তলোয়ার দিয়ে কোনো মানুষকে হত্যা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
আফ্রিকার স্মারক-চিহ্ন হিসাবে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা তরবারি ক্রয় করেছিলেন হ্যারি, এইবার সেই অস্ত্রটাকে তিনি ওঝার হাতে তুলে দিলেন।
তলোয়ারটা সে হ্যারির হাতে ফিরিয়ে দিল।
হ্যারি কিন্তু তাকে ছাড়লেন না। এক ধাক্কায় ওঝাকে মাটিতে ফেলে তিনি তলোয়ারের ফলা তার কণ্ঠদেশে স্থাপন করলেন, তারপর বললেন, তুমি আমাকে মারতে পারবে না। কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করব। এখনই হত্যা করব।
বলাই বাহুল্য, লোকটিকে হত্যা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হ্যারির ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তাকে বে-ইজ্জত করার জন্যই হ্যারি এত কাণ্ড করছিলেন। দারুণ হাসির আবেগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, অবরুদ্ধ হাস্যকে দমন করার চেষ্টায় তিনি প্রাণপণে ক্রোধের অভিনয় করছিলেন।
নিগ্রো ভৃত্যটি তার কম্পিত কণ্ঠস্বরে অবরুদ্ধ হাস্যের পরিবর্তে নিদারুণ ক্রোধের আভাস অনুমান করে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
ওঝা কিন্তু বিশেষ ভয় পায়নি। হ্যারির হাতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে বলল, মাসা! ওই ওষুধটাই তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
হ্যারি সচমকে নিজের হাতের দিকে তাকালেন। দুই হাতের কবজির ওপর একসময় তিনি শখ করে উলকি আঁকিয়েছিলেন। ওঝা জানাল ওই উলকির চিহ্নই নাকি তাঁকে রক্ষা করেছে।
ওঝা অসন্তুষ্ট হয়নি। সে হ্যারিকে আফ্রিকা ত্যাগ করতে বলল। সে আরও বলল, মাসা যদি আফ্রিকা না-ছাড়েন তবে তার আঙুলের ঘা কিছুতেই সারবে না।
ওঝার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। হ্যারি যতদিন আফ্রিকাতে ছিলেন ততদিন তার আঙুলের ক্ষত তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছে। আফ্রিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হওয়ার পর তার আঙুলের ঘা শুকিয়ে যায় এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করেন।
উপরে বর্নিত কাহিনিটি মনগড়া গল্প নয়, বাস্তব সত্য। কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের নামও যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, কোনো কিছুর পরিবর্তন করা হয়নি।
ইয়েলো হ্যান্ড ও বাফেলো বিল কোডি
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম অংশে যে বিখ্যাত দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেই যুদ্ধের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম ইয়েলো হ্যান্ড ও বাফেলো বিল কোডি। রেড ইন্ডিয়ানদের এক দলপতির নাম ইয়েলো হ্যান্ড। বাফেলো বিল কোডি ছিল আমেরিকার তদানীন্তন সেনাবাহিনীর জনৈক অশ্বারোহী সৈনিক।
যুদ্ধটা কী করে ঘটেছিল এইবার সেই কথাই বলছি। পূর্বোক্ত অশ্বারোহী বাহিনীর একটি দল একদিন হঠাৎ আকস্মিকভাবে শেনি জাতীয় রেড ইন্ডিয়ানদের একদল যোদ্ধার সামনে পড়ে গেল। রেড ইন্ডিয়ানদের ওই দলটা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিল, কিন্তু তারা আমেরিকার অশ্বারোহী সৈন্যদের আক্রমণের চেষ্টা করল না। কারণ, সর্দার ইয়েলো হ্যান্ড ইতিমধ্যেই কোডিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে দল ছেড়ে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ এতগুলো লোকের ভিতর থেকে কোডিকে সর্দার কেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বেছে নিয়েছিল এই প্রশ্নটা হয়তো কারো মনে জাগতে পারে তাই পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, সেই যুগে বাফেলো বিল কোডি নামটি ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের ক্রোধ আর ঘৃণার বস্তু। কারণ রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে বিল কোডি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। কোডিকে চিনতে পেরেছিল বলেই সর্দার ইয়েলো হ্যান্ড তাকে দ্বৈরথ রণে আহ্বান করেছিল। সর্দারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এল কোডি। সর্দারও অগ্রসর হল–দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে লক্ষ করে তিরবেগে এগিয়ে আসতে লাগল, হাতে তাদের গুলিভরা রাইফেল। ধাবমান ঘোড়ার পায়ে পায়ে মধ্যবর্তী দূরত্ব যখন খুব কমে এসেছে, তখন হঠাৎ নিজের উইনচেস্টার রাইফেল তুলে গুলি ছুড়ল কোডি। ইয়েলো হ্যান্ড গুলি চালানোর সময় পেল না, তার আহত ঘোড়া মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই কোডি নিজের ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে ধরাশয্যা অবলম্বন করল। দুজনেই একসঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর পরস্পরকে লক্ষ করে গুলি চালাতে লাগল উন্মাদের মতো। যোদ্ধাদের মধ্যে কেউ লক্ষ্য ভেদ করতে পারল না। অবশেষে যখন তাদের গুলি ফুরিয়ে গেল তখন অকেজো রাইফেল ফেলে দিয়ে তারা কটিবন্ধের খাপ থেকে টেনে নিল শানিত ছুরিকা। সতর্ক দৃষ্টিতে পরস্পরকে নিরীক্ষণ করতে করতে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল দুই যোদ্ধা, দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বীর পাঁয়তাড়ার মধ্যে ফঁক খুঁজতে খুঁজতে ব্যস্ত… আচম্বিতে যেন এক অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল। সঙ্গেসঙ্গে ছুরির ফলকে ফলকে জাগল বিদ্যুতের চমক…