বিল স্মিথ এখানে অন্তত বার-ছয়েক এসে আইজ্যাকের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।
স্মিথ ছাড়া আরও অনেক মার্শাল আমার পিছু নিয়েছে। সদম্ভে ঘোষণা করল বিল, আমি ওদের পরোয়া করি না।
পুরো দুটো দিন রজার্সের সঙ্গে কাটালেও রাইফেলটাকে বিল একবারও হাতছাড়া করেনি।
সে সবসময়েই হাসিখুশি, কিন্তু তার সতর্ক দৃষ্টি সর্বদাই রজার্সের উপর। তৃতীয় দিন সকালে রজার্সের বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে গেল। তারপর অশ্বপৃষ্ঠে টালসিতে গিয়ে ভার্ডিগ্রিস কিড এবং কুক ভাইদের সঙ্গে মিলিত হল বিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই রক্ষীবাহিনীর তাড়া খেয়ে আবার তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
১৮৯৫ সালের জানুয়ারি ২৯ তারিখে আবার আইজ্যাক রজার্সের গৃহে উপস্থিত হল অশ্বারোহী বিল :ওহে রজার্স, তুমি চটপট নোয়াটাতে গিয়ে ম্যাগিকে নিয়ে এসো। আমি বেশ কিছুদিন এখানে বিশ্রাম নেব। চারদিকে হাওয়া বড়ো গরম, গতিক সুবিধের নয়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বিশ্রাম করো বিল, রজার্স বলল, রাইফেল রেখে দিয়ে একটু আরাম করো।
ওই কথাটি বলবে না আইজ্যাক। আমি রাইফেলের উপর নজর রাখি, তাই রাইফেলও আমার উপর নজর রাখে।
ক্রফোর্ড গোল্ডসবি বহু নরহত্যা করেছিল। তার ভগ্নীপতিকে সামান্য কারণে সে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। অনেক মানুষকে সে খুন করেছে সম্পূর্ণ অকারণে। কিন্তু রজার্স যে তাকে ধরিয়ে দিতে চায় সে-কথা জেনেও কেন যে ওই লোকটিকে বিল খুন করেনি তা বলা মুশকিল। খুব সম্ভব রজার্সের সঙ্গে একটা বিপজ্জনক খেলায় নেমে সে মনে মনে আনন্দ আর উত্তেজনার চমক উপভোগ করেছিল। রজার্স যে এক সময়ে যুক্তরাজ্যের অন্যতম মার্শাল ছিল এবং বর্তমান ডেপুটি মার্শাল উইলিয়াম স্মিথের সঙ্গে চক্রান্ত করে সে যে বিলকে ধরতে চাইছে, সেইসব তথ্যও বিলের অজ্ঞাত ছিল না। রজার্সের আর এক প্রতিবেশী ক্লিং স্কেলসও বিলকে ধরিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। শুধু পুরস্কারের লোভেই যে সে এই কাজ করছিল তা নয়। উইটাম্পকিন শহরে যে স্কেলসদের দোকানে বন্ধুদের নিয়ে বিল ডাকাতি করেছিল, সেই স্কেলসদের এক আত্মীয় ছিল ক্লিং স্কেলস।
ম্যাগি গ্ল্যাস আবার সতর্ক করে দিল তার বন্ধুকে, কিন্তু চেরোকি বিল তার কথায় কান দিল না।
রজার্স অবশ্য খুবই যত্ন করছিল তার অতিথিকে। আদর করে এক গ্যালন হুইস্কি নিয়ে এল সে বিলের জন্য। দুঃখের বিষয়, বিল সেই হুইস্কির স্বাদ গ্রহণ করতে রাজি হল না। রজার্স তার প্রতিবেশী ক্লিংকে নিয়ে এসেছিল তাস খেলার অন্যতম সঙ্গী হিসেবে। অতিথিকে সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন সুস্বাদু পদ রান্না করেছিল রজার্সের বউ। অবশ্য ওইসব রান্নার উপকরণ সংগৃহীত হয়েছিল চেরোকি বিলের টাকা থেকেই।
টেবিলের উপর সাজানো আহার্য নিয়ে নৈশভোজনে বসেছিল বিল। চেয়ারে উপবিষ্ট বিলের পিঠ ছিল দেয়ালে, মুখ ছিল দরজার দিকে ফেরানো এবং কোলের উপর ছিল উইনচেস্টার রাইফেল।
সারা দুনিয়া জানে তোমার বন্ধুরা তোমাকে ভালোবাসে, ক্ষুণ্ণকণ্ঠে অভিযোগ জানাল রজার্স, কিন্তু তুমি বন্ধুদের বিশ্বাস করো না। সত্যি, এটা খুবই অপমানের বিষয়।
বিলের ওষ্ঠাধরে ফুটল হিংস্র হাস্য; নির্বিকার স্বরে সে বলল, আইক, ওই মাংসের পাত্রটা এগিয়ে দাও তো।
খাওয়া শেষ হলে তারা তাস খেলতে বসল। খেলা চলল ভোর চারটে পর্যন্ত; এর মধ্যে একবারও কোলের উপর থেকে রাইফেল নামায়নি বিল। তিন খেলোয়াড়ই অনুভব করছিল হাওয়া খারাপ, পরিবেশ সুবিধের নয়। অবশেষে চারটের সময় তিনজনেই শুয়ে পড়ল।
একই খাটে একই বিছানায় শয্যা নিয়েছিল তিনজন। কিছুক্ষণ পরে অতি সন্তর্পণে খাট থেকে নিঃশব্দে নামল রজার্স, তৎক্ষণাৎ বিলের পা পড়ল মেঝের উপর এবং মুহূর্তপূর্বে শায়িত বিল হল রাইফেল হাতে দণ্ডায়মান!
মধুর হেসে বিল জানতে চাইল, কোনো শব্দ-টব্দ শুনে উঠে পড়েছ বুঝি, আইক?
আইক আবার শয্যা গ্রহণ করল। বিলও শুয়ে পড়ল তার নিজস্ব জায়গায়।
একটু পরে আবার যেই আইক উঠেছে, সঙ্গেসঙ্গে বিলও উঠে দাঁড়িয়েছে রাইফেল নিয়ে এবং নিরীহ কণ্ঠে আইকের নিদ্রাভঙ্গের কারণ জানতে চেয়েছে। বার বার একই ঘটনার যখন পুনরাবৃত্তি ঘটল, তখন হতাশ হয়ে নিদ্রার ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করল আইক।
ঘুম ভাঙতে আইক দেখল সে একাই শুয়ে আছে; চারদিকে ঝলমল করছে সূর্যালোক। সে বুঝল বেশ বেলা হয়েছে। শয্যাত্যাগ করে জামাকাপড় চড়িয়ে আইক রান্নাঘরে এসে দেখল ওই ঘরে খাওয়ার টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে বিল–কোলে নিত্যসঙ্গী রাইফেল, মুখে বিদ্রপের মৃদু হাসি।
স্কেলসও ছিল সেখানে, মিসেস রজার্স ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশ পরিবেশন করছিল। খাওয়া শেষ হলে তিনজনই চেয়ার পেতে উপবিষ্ট হল অগ্নিকুণ্ডের সামনে। শীতের দেশ, সকালের কনকনে ঠান্ডায় অগ্নিকুণ্ডের উত্তপ্ত সান্নিধ্য বেশ আরামদায়ক।
হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকল বিলের বান্ধবী ম্যাগি গ্লাস। চঞ্চল-চরণে সে ঘরের এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাতায়াত করার সময়ে তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি ঘুরছিল উপবিষ্ট তিন ব্যক্তির মুখের উপর। কয়েকবার ওইভাবে ঘোরাঘুরি করার পর হঠাৎ বিলের পাশে এসে দাঁড়াল ম্যাগি এবং পুরোনো নাম ধরে সম্বোধন করে বলল, ক্রফোর্ড! তুমি এখানে রয়েছ কেন? তাড়াতাড়ি চলে যাও এখান থেকে। তুমি কি জানো না, ওরা দুজনে তোমাকে ধরিয়ে দিতে চায়?