মে মাসের রাত্রি, আলো-আঁধার-মাখা রাজপথের উপর শুরু হল মারামারি। সজোরে ঘুসি চালাল ক্রফোর্ড। ছিটকে পড়ল জেক। পরক্ষণেই বিড়ালের মতো লঘু চরণে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে লিউইস ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল শক্তির চাইতে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি। হাত ঝেড়ে লিউইস ঢুকল নাচঘরের ভিতর, বাইরে মাটিতে পড়ে রইল প্রহার-জর্জরিত ক্রফোর্ডের প্রায়-অচেতন অবসন্ন দেহ।
কয়েকটি দর্শক ধরাধরি করে আহত ক্রফোর্ডকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল।
ছেড়ে দাও! ক্রোধরুদ্ধ হিংস্র কণ্ঠে গর্জে উঠল ক্রফোর্ড, আমাকে একা থাকতে দাও।
টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়ে এসে একবার দাঁড়াল সে। তার দুই চোখ ঘুসির আঘাতে প্রায় বুজে এসেছে সেই আধবোজা চোখের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দরজার উপর নিবদ্ধ; ওই দরজা দিয়েই নাচঘরের ভিতর ঢুকেছে জেক লিউইস।
আসরের মুক্ত দ্বারপথে ভেসে আসছে নৃত্যগীত ও বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনি, কিন্তু সেই শব্দের তরঙ্গ ক্রফোর্ডের কানে প্রবেশের পথ পায়নি। তার অন্তরের অন্তস্থল ভেদ করে জেগে উঠেছে এক হত্যাপাগল হন্তারক, প্রতিশোধের হিংস্র আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ না-করে তার তৃপ্তি নেই।
দুই হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটিকে সে নিরীক্ষণ করল। মুঠির হাড়গুলো ঘুসোঘুসির ফলে ক্ষতবিক্ষত। হাত দুটো নামিয়ে নিল ক্রফোর্ড, তারপর অস্পষ্ট ভগ্ন স্বরে বলে উঠল, এই শেষ। হাতাহাতি মারামারির মধ্যে আমি আর নেই।
কাছাকাছি যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা পিছিয়ে গেল সভয়ে। কণ্ঠস্বরে খুনির উদগ্র আগ্রহ বুঝে নিতে তাদের একটু দেরি হয়নি।
ক্রফোর্ড যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গাটার উপর আলো এসে পড়েছিল নাচঘরের ভিতর থেকে। ক্রফোর্ড গোল্ডসবি আলোকিত স্থান ত্যাগ করে ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের ভিতর পদচালনা করল। তার দীর্ঘ দেহ রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নাচঘরের দরজা ঠেলে বাইরে ছুটে এল ক্রফোর্ডের বান্ধবী ম্যাগি গ্লাস। সে চিৎকার করে ডাকল, ক্রফোর্ড! ক্রফোর্ড!
উত্তর এল না। আবার চিৎকার করে ডাক দিল তরুণী। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এইবার ভেসে এল ক্রফোর্ডের কণ্ঠস্বর, এখানে এসো না। এখন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। পরে সাক্ষাৎ হবে। সম্ভবত নোয়াটা শহরে তোমার সঙ্গে আমি দেখা করতে পারব।
যেখানে তার ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, সেইখানে এগিয়ে গেল ক্রফোর্ড–তারপর একলাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাহনকে চালনা করল তিরবেগে। সারারাত ধরে ছুটল ঘোড়া। ভোরের দিকে সে এসে পৌঁছোল বাড়িতে। ক্রফোর্ড তার ঘুমন্ত মা আর ভাইকে জাগাল না, নিঃশব্দে বাড়ির ভিতর ঢুকে সে অস্ত্র গ্রহণ করল এবং পথশ্রান্ত বাহনটিকে রেখে আর-একটি তাজা ঘোড়া বেছে নিল আস্তাবল থেকে।
পরের দিন। বেশ বেলা হয়েছে। ধক ধক জ্বলছে সূর্যের আলো। ওল্ড টাউন শহরের জি. এল. বাউডেন নামক ভদ্রলোকটির গোলাবাড়ির দিকে হেঁটে চলেছে লিউইস। ওইখানেই সে কাজ করে।
উঠোন পার হয়ে গোলাবাড়ির এলাকার মধ্যে লিউইস পদার্পণ করল। মাথা নীচু করে সে পদচারণা করছিল অন্যমনস্কভাবে, হঠাৎ তার কানে এল তীব্র কণ্ঠস্বর, এই যে লিউইস! ঠিক সময়েই তুমি এসে পড়েছ!
সচমকে মুখ তুলে লিউইস দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোেল্ডসবি ক্রফোর্ড!
ক্রফোর্ডের মুখের ওপর বিগত রাত্রের প্রহার-চিহ্ন দিবালোকে সুস্পষ্ট, ক্ষতবিক্ষত সেই মুখে করাল ক্রোধের হিংস্র অভিব্যক্তি লিউইস সভয়ে নিরীক্ষণ করল, ক্রফোর্ডের ডান হাতে রয়েছে একটা ভারী রিভলভার।
মুহূর্তের মধ্যে লিউইস বুঝে নিল তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মূর্তিমান মৃত্যুদূত; মহা আতঙ্কে পিছন ফিরে সে ছুটল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটল রিভলভারের গুলি। লিউইস ছিটকে পড়ল মাটির উপর। তার মরণাহত দেহ একবার ছটফট করে উঠল। তৎক্ষণাৎ আবার গর্জে উঠল ক্রফোর্ডের রিভলভার। দ্বিতীয় বারের নিক্ষিপ্ত বুলেট লিউইসের শরীর থেকে জীবনের শেষ চিহ্ন মুছে দিল। মৃতদেহ পড়ে রইল নিশ্চল পাথরের মতো, রক্তে ভিজে গেল গোলাবাড়ির প্রাঙ্গণ।
শান্তভাবে চারদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ক্রফোর্ড। কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বলছিল জ্বলন্ত কয়লার মতো।
ক্রফোর্ড দেখতে পেল গোলাবাড়ির দরজা খুলে তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন বাউডেন। অত্যন্ত নির্বিকারভাবে হাত তুলে তাকে অভিনন্দন জানাল খুনি, গুড মর্নিং, মি. বাউডেন।
প্রতি-অভিবাদনের জন্য না-দাঁড়িয়ে গোলাবাড়ি প্রদক্ষিণ করে সে এগিয়ে গেল তার ঘোড়ার দিকে। জন্তুটাকে একটা খুঁটির সঙ্গে সে বেঁধে রেখেছিল গোলাবাড়ির কাছেই। এইবার বাঁধন খুলে সে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হল। একটুও তাড়াহুড়ো না-করে সে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : তিন স্যাঙাতের ত্র্যহস্পর্শ যোগ
বাড়ির পথে যায়নি ক্রফোর্ড। সে জানত তার মাথার ওপর ঝুলছে ফাঁসির দড়ি; স্বচক্ষে তাকে খুন করতে দেখেছে বাউডেন। তার মুখ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরবাসী জেনে যাবে জেক লিউইসকে খুন করেছে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি। অশ্বারোহণে সে এগিয়ে চলল দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ক্রিক নেশান নামক প্রদেশ অভিমুখে।
১৮৯৪ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উইটাম্পকা শহরে এসে পৌঁছোল ক্রফোর্ড। পথশ্রমে সে তখন অবসন্ন, ক্ষুধার্ত। সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু নেই, সম্বলের মধ্যে একটি শ্রান্ত ক্লান্ত অশ্ব, একটি উইনচেস্টার ৩০ রাইফেল এবং কোল্ট, ৪৪ রিভলভার। এক নজরে দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা অত্যন্ত বেপরোয়া এক পলাতক আসামি।