জুয়াড়ি ডিকেনসন ছিল পাকা পিস্তলবাজ। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পনেরো বার পা ফেলে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, সেই দূরত্ব থেকে পিস্তলের গুলি চালিয়ে একটা দোদুল্যমান সুতোকে ছিঁড়ে ফেলতে পারত ডিকেনসন। জুয়াড়ি চার্লস ডিকেনসনের লক্ষ্য ভেদ করার সাংঘাতিক ক্ষমতা সম্বন্ধে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ ছিল অতিশয় অবহিত। জেনারেল অ্যান্ড্রও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্ভুল নিশানার কথা জানতেন, কিন্তু তবুও এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বিলম্ব হয়নি এক মুহূর্তও। দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য তার নির্বাচিত স্থানটির নাম টেনেসি।
পিস্তলধারী দুই যোদ্ধার মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল মাত্র আট পা। পরস্পরকে লক্ষ করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পিস্তল উদ্যত করলেন। প্রথমেই গুলি ছুড়ল ডিকেনসন। মধ্যস্থরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল। প্রতিদ্বন্দ্বীর গুলি নিশ্চয়ই ব্যর্থ হয়েছে? পরক্ষণেই অগ্নি উদগিরণ করে গর্জে উঠল জেনারেল জ্যাকসনের পিস্তল এবং ডিকেনসনের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর। বিবর্ণ রক্তহীন মুখে জেনারেল তার জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন স্খলিত চরণে। জেনারেলের অবস্থা দেখে জনৈক মধ্যস্থ সন্দেহ করলেন ডিকেনসনের লক্ষ্য বোধ হয় ব্যর্থ হয়নি। সন্দেহ সত্য। জেনারেলের পাঁজরে বিদ্ধ হয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বীর গুলি। দাঁতে দাঁত চেপে সেই আঘাত সহ্য করে জেনারেল যখন তার নিশানা স্থির করছিলেন, তখনও শত্রুর নিক্ষিপ্ত বুলেট তার দেহের ভিতরেই ছিল! আহত জেনারেল পরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি হয়েছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
জেফারি হাডসন ও অফিসার ক্রফটস
জেফারি হাডসন ছিল ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। অতি ক্ষুদ্রকায় বামন হলেও জেফারি ছিল অতিশয় সাহসী মানুষ। একবার রাজার বাগানে কয়েকটি ক্রীড়ারত শিশুকে যখন একটি অতিকায় টার্কি পাখি আক্রমণ করেছিল, সেইসময় তরবারি হাতে পাখিটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জেফারি হাডসন। ওই টার্কি পাখির দৈহিক আয়তন জেফারির চাইতে বড়ো ছিল, কিন্তু নিপুণ হাতে তরবারি চালিয়ে পাখিটাকে হত্যা করে হাডসন সেদিন শানিত নখচঞ্চুর আক্রমণ থেকে বিপন্ন শিশুদের রক্ষা করেছিল।
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মতোই মর্যাদাবোধ সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল জেফারি হাডসন। একদিন ক্রফটস নামক জনৈক অফিসার হাডসনকে নিয়ে একটু মজা করার চেষ্টা করল। হাডসন খেপে গেল, সে ক্রফটসকে আহ্বান করল দ্বন্দ্বযুদ্ধে।
এতটুকু একটা পুঁচকে মানুষ রাজার খাবারের বাটির মধ্যে যে আত্মগোপন করে বসে থাকতে পারে তার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ? ক্রফটস তো হেসেই আকুল। হাসতে হাসতেই সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। দ্বন্দ্বযুদ্ধে নির্দিষ্ট স্থানে যোগ দিতে এল জেফারি হাডসন। ক্রফটসও এসেছিল, তবে তার সঙ্গে তলোয়ার কিংবা পিস্তল ছিল না–অস্ত্র হিসাবে সে বাগিয়ে ধরেছিল একটা জল দেবার পিচকারি।
দ্বিতীয়বার অপমানে হাডসন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তার সঙ্গে ছিল একজোড়া পিস্তল–একটা পিস্তল সে ক্রফটসের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তাকে অস্ত্র ব্যবহার করতে অনুরোধ করল।
এবার আর পায়ে হেঁটে নয়। অশ্বপৃষ্ঠে পিস্তল হাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের সম্মুখীন হল।
বামন জেফারি হাডসনের পিস্তল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি যখন ক্রফটসের বক্ষ ভেদ করল, তখনও তার মুখ থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে যায়নি।
হাসতে হাসতেই মৃত্যুবরণ করল অফিসার ক্রফটস।
দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণাম
প্রথম পরিচ্ছেদ : হন্তারক
কথায় কথায় ঝগড়া। তারপরই মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ।
পশ্চিম আমেরিকায় অবস্থিত ঊনবিংশ শতাব্দীর শহর ফোর্ট গিবসন-এর একটি নৃত্যশালায় দুটি ক্রুদ্ধ যুবকের মধ্যে যে-লড়াইটা শুরু হয়েছিল, সেই মুষ্টিযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিট পরেই কিন্তু পরবর্তীকালে ওই দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণাম সমগ্র দেশের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাস ও বিভীষিকার করাল ছায়া।
ফোর্ট গিবসন শহর। ওই শহরের একটি নৃত্যশালায় রাতের আসর জমজমাট। পুরুষদের সঙ্গে মেয়েরাও যোগ দিয়েছে মহা আনন্দে; চলছে নাচগান, হইহুল্লোড়। হঠাৎ সামান্য কারণে ঝগড়া বাধল দুটি যুবকের মধ্যে। যুবকদের নাম ক্রফোর্ড গোল্ডসবি এবং জেক লিউইস।
ক্রফোর্ডের বয়স লিউইসের চাইতে অনেক কম, তার শরীরটাও বেশ দশাসই জোয়ানের মতো। বিপুলবপু দীর্ঘদেহী ক্রফোর্ডের সামনে জেককে নিতান্তই নগণ্য মনে হয়। কিন্তু লিউইস মারামারিতে পোক্ত–বহুদিনের অভিজ্ঞতার ফলে সে মার খেতে যেমন অভ্যস্ত, মার ফিরিয়ে দিতেও তেমনই ওস্তাদ। অতএব ক্রফোর্ড যখন তার ঘুসি হজম করে পালটা ঘুসিতে তাকে মেঝের উপর শুইয়ে দিল, তখনই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না সে।
হঠাৎ বাধা দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ওহে ছোকরারা, তোমরা বাইরে গিয়ে ফয়সালা করো। এটা মারামারির জায়গা নয়। এখানে মহিলারা আছেন।
বেশ, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ক্রফোর্ডের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল লিউইস, আমি বাইরে যাচ্ছি।
খুব ভালো কথা। আমিও যাচ্ছি, সদম্ভে উত্তর দিল ক্রফোর্ড।
নাচঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল দুই যুযুধান।