মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও এতটুকু কাতর হয়নি দুর্দান্ত মেক্সিকান। শত্রুর দিকে তাকিয়ে ফিলিপ বলেছিল, সিনর টবিন, কাজটা একটু তাড়াতাড়ি সারো। তোমার ছুরিতে তেমন ধার নেই!
এসপিনোসা বংশের দুই খুনি ফিলিপ আর জুলিয়েনের ছিন্ন মুণ্ড নিয়ে গারল্যান্ড দুর্গে উপস্থিত হল টবিন। একটা থলির ভিতর থেকে মুণ্ড দুটি বের করে গভর্নরের ডেস্কের উপর টবিন সাজিয়ে দিয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই সময় সরকারি কোষাগারে টাকা ছিল না, তাই। তৎক্ষণাৎ টবিনকে পুরস্কার দেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু গভর্নর ইভান্স তার পকেট থেকে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে একটি চমৎকার হরিণ-চর্মের পরিচ্ছদ এবং ভালো একটি রাইফেল টবিনকে উপহার দিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে পুরস্কার হিসেবে যে-অর্থ টবিন পেয়েছিল, তার অঙ্কটা কম নয়—
১৫০০ ডলার!
ক্যাপ্টেন বয়েড ও মেজর ক্যাম্পবেল
১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি বিভাগে ক্যাপ্টেন বয়েড ও মেজর ক্যাম্পবেল নামক দুই সেনাধ্যক্ষের মধ্যে হঠাৎ বাদানুবাদ শুরু হল সেনানিবাসের মধ্যে। মেজর ক্যাম্পবেল অধীন সৈন্যদের উপর যে আদেশ জারি করেছিলেন, সেই আদেশ ক্যাপ্টেন বয়েডের পছন্দ হয়নি এবং তার ফলে উত্তপ্ত বিতর্কের অবতারণা। বয়েডের মতে মেজর সাহেবের পক্ষে ওই আদেশ জারি অনুচিত কার্য। মেজরের বক্তব্য, উচিত কাজই করেছেন তিনি। দুজনেই নিজস্ব ধারণায় অটল। তীব্রস্বরে বাদানুবাদ চলল কিছুক্ষণ, তারপর দেখা গেল ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে স্থানত্যাগ করছেন ক্যাম্পবেল এবং তাকে অনুসরণ করছেন বয়েড। পরবর্তী ঘটনার সঠিক বিবরণ কেউ সংগ্রহ করতে পারেনি; তবে এটুকু জানা যায় যে, দুজনের মধ্যে পিস্তল নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ ঘটেছিল।
একটা ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে ডুয়েল হয়েছিল, অকুস্থলে কোনো মধ্যস্থ উপস্থিত ছিলেন না। আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ শুনে অকুস্থলে ছুটে এলেন কয়েকজন অফিসার। তাদের সামনে অতিশয় উদবিগ্ন স্বরে ক্যাম্পবেল তার মরণাহত প্রতিদ্বন্দ্বীকে উদ্দেশ করে বললেন, বয়েড, সাক্ষীদের সামনে স্বীকার করো যে লড়াইটা ন্যায়সঙ্গতভাবেই হয়েছিল।
স্খলিতস্বরে বয়ে যা বললেন, সেই বক্তব্য হল ক্যাম্পবেলের পক্ষে মারাত্মক।না, লড়াই ন্যায়সংগত হয়েছিল এ-কথা বলা যায় না। তুমি আমাকে প্রস্তুত হওয়ার সময় দাওনি। তুমি খুব খারাপ লোক, ক্যাম্পবেল। ওইকথা বলার পরেই বয়েডের মৃত্যু হয়।
ক্যাম্পবেলের বিচার হল। বয়েডের মৃত্যুকালীন উক্তি ক্যাম্পবেলকে ঠেলে দিল মৃত্যুর মুখে। বিচারে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিলেন মেজর ক্যাম্পবেল।
গিলস বোথাম ও টম ব্রাস
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ঠিক ক্রিসমাসের আগে লন্ডনের একটি ক্লাবে গিলস বোথাম ও টম ব্রাস নামক দুই ভদ্রলোকের মধ্যে ভীষণ তর্ক শুরু হল। তর্কের বিষয়বস্তু খুবই তুচ্ছ, কিন্তু শ্লেষসিক্ত কণ্ঠের বাদানুবাদের ফল হল অতিশয় মারাত্মক। বোথামের ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চ্যালেঞ্জ তর্কযুদ্ধকে টেনে আনল পিস্তল-ডুয়েল নামক ভয়াবহ দ্বৈরথের প্রাণঘাতী সম্ভাবনার মধ্যে। সাধারণত দিনের আলোতেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু উত্তেজিত ভদ্রলোক দুটি আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারকে উপেক্ষা করেই তৎক্ষণাৎ ফয়সালা করার জন্য উগ্রীব হয়ে উঠলেন। ক্লাবের মধ্যে ডুয়েল লড়া সম্ভব নয়, অতএব নিকটস্থ একটি মাঠের দিকে দুজনে রওনা হলেন। মধ্যস্থ হিসাবে দুটি সঙ্গী জোগাড় করতেও তাদের দেরি হয়নি। তখন তুষারপাত হচ্ছে। পিস্তলের নিশানা অস্পষ্ট করে তুলেছে সন্ধ্যার ছায়া–দুই প্রতিযোগী অন্ধকারকে অগ্রাহ্য করে পিস্তল তুললেন। মধ্যস্থের নির্দেশ পাওয়ামাত্র গুলি ছুড়লেন বোথাম। তাঁর লক্ষ্য ব্যর্থ হল। এবার পিস্তল তুললেন টম ব্রাস এবং ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর নিশানা স্থির করতে লাগলেন। মধ্যস্থ দুজন ও বোথাম বুঝলেন আজ আর রক্ষা নেই। কারণ, টম ব্রাস হলেন ক্র্যাক-শট–তাঁর হাতের গুলি কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন বোথাম। পিস্তলের লক্ষ্য স্থির করে গুলি চালাতে উদ্যত হলেন টম ব্রাস আর ঠিক সেই মুহূর্তে নীরবতা ভঙ্গ করে সন্ধ্যার বাতাসে ভেসে এল ক্রিসমাসের সংগীত-ধ্বনি। টম শুনলেন সুরের জাল বুনতে বুনতে গায়করা সমগ্র মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি প্রীতি ও স্নেহপরায়ণ হতে অনুরোধ করছে অদ্ভুতভাবে সেই সংগীত টমের হৃদয়কে পরিবর্তিত করল। উদ্যত পিস্তল নামিয়ে নিলেন টম ব্রাস…
যে ক্লাবঘরের ভিতর পূর্বোক্ত দ্বন্দ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, আবার সেইখানে দুই যুযুধানকে দেখা গেল, অবশ্যই তাদের হাতে পিস্তল ছিল না ছিল কাঁচের পানপাত্র। তারা হাসিমুখে পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করছেন এবং তাঁদের পানপাত্রে স্থান পেয়েছে দুটি বিভিন্ন জাতের সুরা যাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রথমে বাগযুদ্ধ ও পরে দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ও চার্লস ডিকেনসন
জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ছিলেন যেমন শক্তসমর্থ, তেমনি তার কথাবার্তাও ছিল চোখা চোখা। রেখে-ঢেকে কথা বলতে তিনি জানতেন না, প্রয়োজনে উচিত কথা শুনিয়ে দিতে তিনি ইতস্তত করতেন না কখনোই, এবং তার ফলে যেকোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে তাঁর আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে চার্লস ডিকেনসন নামে একটি কুখ্যাত জুয়াড়ির সঙ্গে তার ঝগড়া বেধে গেল। আগেই বলেছি জেনারেল ছিলেন স্পষ্টবক্তা। তার শানিত বাক্যবাণে বিপর্যস্ত জুয়াড়ি খেপে গিয়ে তাকে পিস্তলের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাল।