পূর্বোক্ত স্কাউটরা ছিল নির্ভীক চরিত্রের মানুষ, বন্দুক পিস্তলে তাদের নিশানা অব্যর্থ। বনপথে অনুসরণ-কার্যে দুঃসাহসী স্কাউটের অসাধারণ দক্ষতা আজও জনশ্রুতি ও ইতিহাসের গল্পকথা হয়ে আছে। পূর্বে উল্লিখিত টম টরিন ছিল ওইরকম এক স্কাউট।
সেনাবাহিনী যখন অসহায় বলে প্রমাণিত হত, তখনই স্কাউটের সাহায্য গ্রহণ করতেন সেনাধ্যক্ষ। কিছুতেই ফিলিপকে জব্দ করতে না-পেরে কর্নেল ট্যাপ্পান চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করলেন ফোর্ট গারল্যান্ড দুর্গ থেকে কর্নেলের তলব পেয়ে তার সামনে উপস্থিত হল স্কাউট টম টবিন। সেনাবাহিনী থেকে দুরূহ কাজের ভার নিলে দস্তুরমতো পারিশ্রমিক পেত ভারপ্রাপ্ত স্কাউট, অতএব টম টবিনও যে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশা নিয়ে এসেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কর্নেলের বক্তব্য শুনে টম টবিন জানাল একটিমাত্র যোগ্য সহকারী পেলেই সে ফিলিপ এসপিনোসার পশ্চাদ্ধাবন করতে রাজি, কিন্তু কর্নেল ট্যাপ্লান বললেন, ফিলিপের মতো ভয়ানক দস্যুর মোকাবেলা করতে হলে যথেষ্ট লোকবল প্রয়োজন–অতএব, তার আদেশে পনেরোজন সশস্ত্র সৈনিক এগিয়ে এল টবিনকে সাহায্য করতে। ওই সেনাদল ছাড়া আরও একটি মেক্সিকান বালক ছিল টবিনের সঙ্গী। বালকটিকে নির্বাচন করেছিল টবিন স্বয়ং। ১৮৬৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ফোর্ট গারল্যান্ড নামক দুর্গ থেকে টম টবিন যাত্রা করল হন্তারক ফিলিপ এসপিনোসার সন্ধানে।
তিন দিন তিন রাত্রি ধরে চলল অবিরাম অনুসরণ-পর্ব, তারপর এক জায়গায় এসে কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখে থামল মানুষ-শিকারির দল।
উটা জাতীয় রেড ইন্ডিয়ানদের পায়ে পায়েই ওই চিহ্নগুলির সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সেই পদচিহ্নগুলিকে মেক্সিকান খুনিদের পায়ের ছাপ মনে করে বিভ্রান্ত হল ছ-জন সৈন্য এবং টবিনের নির্দেশ অমান্য করে পূর্বোক্ত পদচিহ্নের অনুসরণ করতে সচেষ্ট হল। ফলে টবিনের লোকবল বেশ কিছু কমে গেল।
পরের দিন সকাল ন-টা কি দশটার সময়ে টবিনের দল বনপথে দুটি ষাঁড়ের পদচিহ্ন আবিষ্কার করল। টবিন পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে বুঝতে পারল, জন্তু দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্ত ফিলিপ এবং তার কিশোর সঙ্গী জুলিয়েন। নির্ভুলভাবে তাদের অনুসরণ করতে লাগল টবিন। কিছুক্ষণ করে দেখা গেল একটি ষাঁড়কে দস্যুরা ছেড়ে দিয়েছে। টবিন বুঝল, মেক্সিকান দস্যু দুটি মাংস খাওয়ার জন্য অপর ষাঁড়টিকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের তাঁবুর দিকে।
আবার শুরু হল অনুসন্ধান। ঘন জঙ্গল আর ঘাসঝোপের ভিতর দিয়ে অপরাধীদের পদচিহ্ন পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু অভিজ্ঞ স্কাউট টবিনের শ্যেনচক্ষু একবারও ভুল করল না, স্থির লক্ষ্যে সে এগিয়ে চলল সৈন্যদের নিয়ে।
এক জায়গায় গোল হয়ে উড়ছিল কয়েকটা কাক। টম টবিন অনুমান করল ওইখানেই ষাঁড়টাকে হত্যা করা হয়েছে। সে আবার অগ্রসর হল। প্রায় এক-শো গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পর অনেকগুলো ম্যাগপাই পাখি (এক ধরনের মাংসাশী পাখি) তার চোখে পড়ল। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দুবৃত্তদের তাবুটাকে আবিষ্কার করল টবিন। সৈন্যদের ডেকে টবিন তাদের কথা কইতে নিষেধ করল। সে আরও বলল, হাত তুলে সংকেত জানালেই সকলে যেন রাইফেল বাগিয়ে বসে পড়ে, কিন্তু নির্দেশ না-পেলে কিছুতেই যেন গুলি না-চালায়।
সঙ্গীদের সাবধান করে দিয়ে আরও কয়েক পা এগিয়ে একটি খুনিকে দেখতে পেল টবিন। ঠিক সেই সময় তার পায়ের তলায় একটা শুকনো গাছের ডাল মট করে ভেঙে গেল। শব্দটা শুনতে পেয়েছিল খুনি, শব্দ লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই টবিনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়।
সচমকে এক লক্ষ ত্যাগ করে দস্যু রিভলভারে হাত দিল, কিন্তু সে গুলি চালানোর আগেই টবিনের রাইফেল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি অব্যর্থ সন্ধানে তার দেহ বিদ্ধ করল।
আহত দুবৃত্ত চিৎকার করে উঠল, হে যিশু, আমাকে দয়া করো! তারপরই সে সঙ্গীর উদ্দেশে হাঁক দিল, পালাও, পালাও! আমি মারা গেলাম!
রাইফেল গুলি ভরতে ভরতে টবিন দেখল নিকটবর্তী খাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক ধাবমান মূর্তি এবং তিরবেগে এগিয়ে চলল একটা ঘন ঘাসঝোপের দিকে–
দুই নম্বর খুনি।
টবিন চেঁচিয়ে উঠল, ওহে ছোকরার দল, গুলি চালাও।
তিনটি সৈনিক একসঙ্গে গুলি ছুড়ল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ব্যর্থ হল।
ততক্ষণে টবিন তার রাইফেলে গুলি ভরে ফেলেছে।
অভ্যস্ত আঙুলের স্পর্শে চকিত অগ্নিশিখার গর্জিত আবির্ভাব, পরক্ষণেই ধাবমান দস্যুর দেহ ধরাশয্যায় লম্বমান।
এক গুলিতেই ফিলিপের কোমর ভেঙে দিয়েছে টবিন।
ভাঙা কোমর নিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারল না ফিলিপ, তবু সে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হল না–একটা গাছ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গাছটার দিকে এগিয়ে গেল ফিলিপ, তারপর সেই ধরাশায়ী বৃক্ষে পৃষ্ঠ স্থাপন করে বাগিয়ে ধরল রিভলভার। একটি সৈন্য টবিনের নির্দেশ অমান্য করে বীরবিক্রমে এগিয়ে গেল দস্যুর দিকে কিন্তু ফিলিপের গুলি তার টুপি উড়িয়ে দিতেই বীরবরের চৈতন্য হল, চটপট পিছিয়ে এসে বনের আড়ালে সে আত্মগোপন করল।
অবশেষে শিথিল হয়ে এল ফিলিপের হাত, অবশ মুষ্টি থেকে খসে পড়ল রিভলভার। টবিন চিৎকার করে শত্রুকে ডাকল, উত্তরে দুর্বল কণ্ঠে একটা শপথ উচ্চারণ করল ফিলিপ। এইবার এগিয়ে গেল টবিন, ফিলিপের চুলের মুঠি ধরে তার ঘাড়টাকে স্থাপন করল গাছের গুঁড়ির উপর, তারপর কটিবন্ধ থেকে খুলে নিল ছোরা কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ না নিয়ে গেলে পুরস্কার মিলবে না।