ক্রোধ, ঘৃণা ও আতঙ্কে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কলোরাডোর মানুষ। জন ম্যাকক্যানন নামে জনৈক প্রতিপত্তিশালী খনি-মালিক নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি বেসরকারি বাহিনী গড়ে তুলল। বনপথে বিচরণ করতে অভ্যস্ত কুড়িটি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত ওই বেসরকারি বাহিনীর প্রত্যেকটি লোক ছিল লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, প্রাণ-দেওয়া-নেওয়ার রক্তাক্ত খেলা খেলতে তাদের আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। বন্দুক-পিস্তলে দক্ষ ভয়ংকর ওই মানুষগুলোর উপযুক্ত নেতা ছিল জন ম্যাকক্যানন। ম্যাকক্যাননের মুখে ছিল মস্ত দাড়ি, দেহ ছিল প্রকাণ্ড। দলবল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সে বেরিয়ে পড়ল হত্যাকারী ফিলিপের সন্ধানে।
বনপথে ঘোরাফেরা করে জীবিকা নির্বাহ করতে যারা অভ্যস্ত, তাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া খুব কঠিন–সেইজন্যই বেছে বেছে ওই ধরনের মানুষ নিয়ে দল গঠন করেছিল ম্যাকক্যানন। কয়েকদিন অক্লান্তভাবে অনুসরণ করার পর ম্যাকক্যানন ও তার বাহিনী জঙ্গলের মধ্যে একদিন খুনিদের আবিষ্কার করতে সমর্থ হল।
অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে বসেছিল দুই দুবৃত্ত, সঙ্গে ছিল তিনটি ঘোড়া। ম্যাকক্যাননের বাহিনী থেকে জো ল্যাম্ব নামে একটি লোক প্রথমে গুলি চালিয়েছিল। গুলি লাগল ভিভিয়েনের পায়ে, সে তৎক্ষণাৎ মাটির উপর ঝাঁপ খেয়ে শুয়ে পড়ল। আহত সঙ্গীর সাহায্যে ছুটে এল ফিলিপ এবং হিংস্রকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে দু-হাতে পিস্তল ছুঁড়তে শুরু করল। অপরপক্ষও চুপ করে রইল না, অগ্নি-উদগিরণ করে গর্জে উঠল অনেকগুলো রাইফেল।
একটা ঘোড়া আর্তনাদ করে ধরাশায়ী হল। তার দেহের আড়ালে দুবৃত্ত দুজন গা-ঢাকা দিয়ে গুলি চালাতে লাগল। সেই ম্যাকক্যাননের সঙ্গে ছিল আটজন স্বেচ্ছাসেবক, বাকি লোকজন সেখানে ছিল না। ওই আটজন লোক নিয়ে খুনি দুটোকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল ম্যাকক্যানন। তার চেষ্টা সফল হল না, দুটি ঘোড়াকে একসঙ্গে ছুটিয়ে দিল ফিলিপ–একটার পিঠে সে বসেছিল, অপর ঘোড়াটার লাগাম ধরে জন্তুটাকে সে ব্যবহার করছিল জীবন্ত ও চলন্ত ঢালের মতো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একটা ঘন ঝোপের মধ্যে প্রবেশ করল ঘোড়া দুটি; একটা ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে অপরটির পিঠে সওয়ার হয়ে ঝড়ের মতো পার্বত্য পথ অতিক্রম করে অদৃশ্য হল ফিলিপ, পিছনে পড়ে রইল তার তরুণ অনুচরের মৃতদেহ। চার্লি কার্টার নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক গুলি চালিয়ে ভিভিয়েনের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল।
ম্যাকক্যানন ও তার বাহিনী এবার অকুস্থল থেকে কয়েকটি থলি কুড়িয়ে পেল। অশ্বারোহীরা ওই ধরনের থলি ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বহন করে। বলাই বাহুল্য, থলিগুলো ছিল দুবৃত্তদের সম্পত্তি। এবার খানাতল্লাশি–থলিগুলোর ভেতর থেকে পাওয়া গেল কাপড়চোপড়, রিভলভার, ছোরা, ঘড়ি প্রভৃতি। ওই জিনিসগুলো ছিল দস্যুহস্তে নিহত একাধিক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওইসঙ্গে একটা ডায়েরিও পাওয়া গিয়েছিল। ডায়েরিতে তারিখ দিয়ে বহু নরহত্যার সংবাদ লেখা রয়েছে–কেমন করে ওই আমেরিকানদের খুন করা হয়েছে সে-কথাও লেখা আছে সবিস্তারে। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ওই ডায়েরির পাতা থেকে জানা গেল ৬০০ আমেরিকানকে হত্যা করার সংকল্প নিয়েছে ফিলিপ এসপিনোসা।
আর একটা কাগজের স্তূপ থেকে এমন ভয়ানক প্রতিজ্ঞার কারণটা বোধগম্য হল। আমেরিকার সেনাবাহিনী বিগত যুদ্ধে মেক্সিকোর ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, তার ফলে শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল একটি এসপিনোসা বংশ। ওই বংশেরই ছেলে ফিলিপকে প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করছিল তার বাপ। ছেলেও বাপের মান রেখেছে, অনেকগুলো আমেরিকানকে সে পরলোকে পাঠিয়েছে–সবসুদ্ধ ৬০০ আমেরিকানকে হত্যা না-করে সে ক্ষান্ত হবে না। সংখ্যাটা বিশেষ করে ছ-শো কেন হল সে-বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
পূর্বোক্ত ডায়েরি ও জিনিসগুলো নিয়ে দলবলের সঙ্গে ফিরে এল ম্যাকক্যানন। ভিভিয়েনের মৃতদেহ অবশ্য তারা অকুস্থলেই ফেলে এসেছিল। ক্যালিফোর্নিয়া গালচ নামক স্থানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে অভিনন্দন জানাল উল্লসিত জনসাধারণ।
ম্যাকক্যানন ভেবেছিল স্বেচ্ছাসেবক চার্লির গুলিতে নিহত তরুণ ভিভিয়েনই দলের সর্দার, অতএব তার মৃত্যুতে এখন আপদের শান্তি। কর্তৃপক্ষ কিন্তু ম্যাকক্যাননের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিছুদিন পরেই জানা গেল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা অমূলক নয়–প্রচণ্ড বিক্রমে আবার আত্মপ্রকাশ করেছে ফিলিপ।
ভিভিয়েনের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ যেতে-না-যেতেই ফিলিপের হাতের কাজ দেখা গেল বিল স্মিথ নামে জনৈক নাগরিক প্রথমে খুন হল, পরবর্তী শিকার হল এক অখ্যাত সৈনিক।
খবর নিয়ে জানা গেল ফিলিপ একটি নূতন সঙ্গী সংগ্রহ করেছে। নূতন সহচরটিও এসপিনোসা বংশের ছেলে, বয়স তার খুবই কম–নাম, জুলিয়েন। বয়সে কৈশোর অতিক্রম না-করলেও খুনোখুনিতে ওস্তাদ ছিল জুলিয়েন, মানুষ মারতে তার হাত কাঁপত না একটুও। ফিলিপ ও জুলিয়েনের কবলে প্রাণ হারাল আরও কয়েকজন অভাগা আমেরিকান।
হত্যা-হাহাকারে পরিপূর্ণ বর্তমান নাটকের রক্তাক্ত রঙ্গমঞ্চে এইবার প্রবেশ করল এক দুর্ধর্ষ ব্যক্তি–টম টবিন।
যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় দুর্গম অরণ্যপথে রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণে বহু আমেরিকানের প্রাণহানি ঘটেছে। ওই ভয়ংকর রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করে জীবিকা নির্বাহ করত একদল আমেরিকার মানুষ–ইতিহাসে তাদের নামকরণ হয়েছে স্কাউট।