পরবর্তী ঘটনাগুলি হচ্ছে বীভৎস রক্তারক্তির ধারাবাহিক ইতিহাস। খুনের পর খুন করতে করতে সদলবলে ফিলিপ এগিয়ে চলল ক্যালিফোর্নিয়া গালচ নামক খনি-এলাকায়। জর্জ ব্রুস নামে একজন আমেরিকান ভদ্রলোককে তারা ওই অঞ্চলে খুন করেছিল। খুনের ধরনটা ছিল পূর্বে উল্লিখিত বৃদ্ধ হেনরির হত্যাকাণ্ডের অনুরূপ। স্থানীয় শেরিফ ও তার বাহিনী খুনিদের অনুসরণ করতে গিয়ে পথের মধ্যে আরও কয়েকটা রক্তাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু খুনিদের সে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
হত্যার তাণ্ডব চলল দীর্ঘদিন ধরে। প্রথম প্রথম খুনির স্বরূপ নির্ণয় করতে পারেনি সরকার কে দায়ী এই হত্যাকাণ্ডগুলির জন্য? রেড ইন্ডিয়ান? সন্ত্রাসবাদী বিদ্রোহী? কর্তৃপক্ষ বিভ্রান্ত, বিমূঢ়। অনেক সময় দেখা গেছে নিহত মানুষের ধনসম্পত্তি তার সঙ্গেই অবস্থান করছে, অর্থাৎ নিছক রক্তপিপাসাকে তৃপ্ত করার জন্যই খুন করেছে খুনি। স্থানীয় দস্যুরা এভাবে অনর্থক নরহত্যা করে না। মৃতদেহের মাথার চামড়া অক্ষত দেখে বোঝা যায় রেড ইন্ডিয়ানরাও ওইসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়, কারণ, রেড ইন্ডিয়ানদের প্রথা অনুসারে কাউকে হত্যা করলে নিহত ব্যক্তির চুলসুদ্ধ মাথার চামড়া তারা ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে যায়। মৃতদেহের অঙ্গে উজ্জ্বল পোশাকপরিচ্ছদ থাকলে সেগুলি অবশ্য খুনি লুঠ করত, আরও লুঠ করত ঘড়ি, আংটি, ছুরি প্রভৃতি বস্তু। মৃতদেহগুলো দেখলেই বোঝা যেত অন্ধ আক্রোশে হত্যাকারী তাদের উপর অস্ত্র চালনা করেছে। শুধু গুলি চালিয়ে নরহত্যা করে খুশি হত না খুনি, বারংবার ছুরিকাঘাত করে নিহত মানুষগুলোকে সে টুকরো টুকরো করে ফেলত। তবে খুনি যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি অত্যন্ত অনুগত সে-বিষয়ে সন্দেহ ছিল না–নিহত মানুষের বুকের ওপর ছুরি দিয়ে আঁকা থাকত রক্তাক্ত ক্রসচিহ্ন অথবা দুটো গাছের ডাল কেটে আড়াআড়িভাবে ক্রস বেঁধে খুনি সেটাকে মৃতদেহের বুক ভেদ করে মাটির ওপর বসিয়ে দিত।
যে-লোকগুলো খুন হয়েছিল, তারা প্রায় সকলেই ছিল খুনির অপরিচিত। নিহত ব্যক্তিদের একমাত্র অপরাধ, তারা ছিল আমেরিকান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের হত্যা করা হত। মনে হয়, ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যে মেক্সিকো এবং আমেরিকার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের সময়ে ওই বৃদ্ধরা আমেরিকা-সরকারের সঙ্গে জড়িত ছিল সন্দেহ করেই খুনি তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। মেক্সিকান ফিলিপ ছিল ঘোর সাম্প্রদায়িক আমেরিকানদের উপর সে ছিল বেজায় খাপ্পা। তার ক্রোধের আগুনে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগল বহু আমেরিকান। কলোরাডো রাজ্যে এমন হত্যাপাগল হন্তারক আগে কখনো আত্মপ্রকাশ করেনি।
ফিলিপ এসপিনোসাকে স্বচক্ষে দেখেও জীবিত আছে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। তবু সেই অল্পসংখ্যক মানুষের বর্ণনা থেকে জানা যায় পূর্বোক্ত নরঘাতক দুবৃত্ত নাকি যেমন লম্বা তেমনই চওড়া–দুই কালো চোখে তীব্র প্রখর দৃষ্টি, চেপটা নাক, চোয়াল ঘিরে ঘন দাড়ির জঙ্গল এবং মাথার ওপর সুদীর্ঘ কালো কেশের নিবিড় সমাবেশ।
ফিলিপের নিত্যসঙ্গী ছিল ভিভিয়েন নামে একটি যুবক। ফিলিপের মতো বিপুল দেহ, প্রচণ্ড শক্তি ও দুরন্ত সাহসের অধিকারী না হলেও ভিভিয়েন ছিল পাকা খুনি–নরহত্যায় তার কুণ্ঠা ছিল না কিছুমাত্র। হিংস্র ও নির্মম ভিভিয়েন ছিল ফিলিপ এসপিনোসার যোগ্য সহচর।
ফিলিপকে যে-মানুষটি প্রথম স্বচক্ষে দর্শন করেছিল, সে এক ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান–নাম, এড মেটকাফ।ফেয়ার প্লে থেকে এলমা শহরে যাচ্ছিল এড, আচম্বিতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বীভৎস দৃশ্য–পথের উপর একটি নিশ্চল নরদেহের উপর পরমানন্দে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে দুটি মানুষ। বলাই বাহুল্য যে, লোক দুটি হচ্ছে ফিলিপ আর ভিভিয়েন। ধাবমান শকটের পথ ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল দুই খুনি, কিন্তু কাজে বাধা পড়ায় তাদের মেজাজ গরম হয়ে উঠল। শকটচালক এডকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল ফিলিপ, অব্যর্থ লক্ষ্যে বুলেট এসে পড়ল এডের বুকে। এড লুটিয়ে পড়ল গাড়ির মধ্যে অবস্থিত কাঠের স্তূপের উপর। কিন্তু লক্ষ্যভেদ করতে পারলেও এডকে খুন করতে পারেনি ফিলিপ এডের বুকপকেটে ছিল একটা ছোটো বই, গুলিটা বইয়ের উপর পড়েছিল বলেই সে বেঁচে গেল। আঘাতের বেগ তাকে উলটে ফেলেছিল বটে, কিন্তু গুলি সেই বইটাকে ভেদ করে তার দেহ স্পর্শ করতে পারেনি।
শকটচালক এড মেটকাফ হত্যাকারীদের বর্ণনা দিয়ে বলেছিল, লোক দুটোর গায়ের রং ফর্সা নয়, সম্ভবত তারা রেড ইন্ডিয়ান। দুজনের মধ্যে যে-লোকটির বয়স বেশি তার মুখখানা থালার মতো, মাথায় লম্বা চুল; আড়েবহরে প্রকাণ্ড ওই খুনির কদাকার চেহারার দিকে তাকালে আতঙ্কে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, মনে হয় একটা হিংস্র জন্তুর সামনে এসে পড়েছি। খুব চড়া রং-এর জমকালো পোশাক পরেছিল দুই খুনি, আর তাদের সর্বাঙ্গ ঘিরে ঝুলছিল মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র রাইফেল, পিস্তল, ছোরা।
ফিলিপের হত্যালীলা চলল অবিরাম। ওইসব হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা অত্যন্ত একঘেয়ে আর বৈচিত্র্যহীন। কলোরাডো রাজ্যের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে চলল ফিলিপ এসপিনোসার রক্তসিক্ত বিজয়-অভিযান।
অবশেষে একদিন মৌচাকে ঢিল পড়ল। লেফটেন্যান্ট জর্জ এল শুপ নামক সেনাবিভাগের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কনিষ্ঠ ভ্রাতা মারা পড়ল ফিলিপের হাতে। মৃত ব্যক্তি ছিল সৈনিক, তার মৃত্যুতে হইচই পড়ে গেল চারদিকে। সৈন্যরা যদি এমনভাবে খুন হয়, তবে জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? এমন ভয়ানকভাবে ওই সৈন্যটিকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যে, তার মৃতদেহ দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়নি–সৈনিকের ছিন্নভিন্ন পরিচ্ছদ বা ইউনিফর্ম থেকেই মৃত ব্যক্তির স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছিল।