- বইয়ের নামঃ ডুয়েল
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আফ্রিকার অভিশাপ
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে সিয়েরা লিওন নামক স্থানে উপস্থিত হলেন: একজন ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার। ভদ্রলোকের নাম হ্যারি উইগিনস।
যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। পূর্বোক্ত অঞ্চলের সৈন্যবাহিনীর জন্য পানীয় জল সরবরাহের বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। ওই পরিকল্পনাগুলিকে কার্যকরী করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার হ্যারি উইগিনস সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকার মাটিতে পদার্পণ করলেন।
বেশ কিছুদিন কাজ করার পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরকারের পক্ষ থেকে হ্যারিকে পাঠানো হল রিজেন্ট নামক একটি নিগ্রো পল্লিতে। জায়গাটার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলেন হ্যারি। কিন্তু জলের রিজার্ভয়ার বসাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, পরিকল্পনা কার্যকরী করার প্রধান বাধা হচ্ছে ঘনসন্নিবিষ্ট লতাগুল্ম ও ঝোপজঙ্গলের নিবিড় সমাবেশ। জলের পাইপ বসাতে গেলে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা দরকার, অতএব একদল স্থানীয় মজুরকে জঙ্গল সাফ করার কার্যে নিযুক্ত করা হল।
কয়েকদিন ভালোভাবেই কাজ চলল। তারপরই হল গোলমালের সূত্রপাত। একদিন সকাল বেলা কার্যস্থলের কাছাকাছি এসে হ্যারি অনুভব করলেন, চারিদিকে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক নীরবতা। মজুরদের কোলাহল অথবা জঙ্গলের ওপর ম্যাচেট নামক ধারালো অস্ত্রের আঘাতজনিত শব্দ একেবারেই শোনা যাচ্ছে না। সব চুপচাপ।
এই অস্বাভাবিক নীরবতার কারণ অনুসন্ধান করতে অকুস্থলের দিকে সবেগে পদচালনা করলেন হ্যারি। যথাস্থানে গিয়ে হ্যারি দেখলেন, মজুরেরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উপরে ঝুলছে এক অদ্ভুত দোলনা।
দোলনাটাকে টাঙানো হয়েছে একটা ময়লা কাপড়ের সাহায্যে। নানারকম আজেবাজে জিনিস রয়েছে দোলনার ভিতরে। ওইসব জিনিসের মধ্যে যে-বস্তুটি হ্যারির দৃষ্টি আকৃষ্ট করল সেটি হচ্ছে সবুজ রং-এর একটি বোতল।
বোতলটা শূন্যগর্ভ নয়, তার মধ্যে রয়েছে খানিকটা তরল পদার্থ। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হ্যারি বুঝলেন, উক্ত তরল পদার্থটি ময়লা জল ছাড়া আর কিছুই নয়।
একটা বিশ্রী দোলনার সামনে এতগুলো কাজের লোক কাজ না-করে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে হ্যারি খেপে গেলেন। মজুরদের সর্দারের কাছে কৈফিয়ত চাইতেই সে জানাল, ওটা ভূতের ওঝার জাদু; ওই বিপজ্জনক জাদুর দোলনাটা সরিয়ে নিলেই তারা মন দিয়ে কাজ করতে পারে।
এই কথা শুনে হ্যারি দৃঢ়পদে দোলনার দিকে অগ্রসর হলেন! সঙ্গেসঙ্গে সমবেত জনতা হাঁ হাঁ করে উঠল–মজুররা সভয়ে জানাল মাসা যেন ওই দোলনা স্পর্শ না-করেন; কারণ যে-ওঝা ওখানে জাদু খাঁটিয়েছে, একমাত্র সেই ব্যক্তি ছাড়া অপর কেউ ওই দোলনা স্পর্শ করলে তার মৃত্যু অবধারিত।
আফ্রিকাতে উইচ-ডক্টর বা ভূতের ওঝার প্রতাপ সাংঘাতিক। স্থানীয় মানুষ ওঝাদের যমের মতো ভয় করে। কিন্তু হ্যারি উইগিনস ইংরেজ; তিনি যখন শুনলেন, যে-ওঝা এই কাণ্ড করেছে তাকে ডেকে আনতে হলে পুরো একটা দিন বসে থাকতে হবে, তখন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।
লাথি মেরে দোলনাটাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন ঘন জঙ্গলের গর্ভে!
দারুণ আতঙ্কে নিগ্রো মজুরের দল মাটিতে শুয়ে পড়ল। একটু পরে মুখ তুলে তারা দেখল তাদের মাসা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং তার দেহের উপর মৃত্যুর কোনো লক্ষণ নেই।
নিগ্রো মজুররা আশ্চর্য হয়ে গেল।
তারা ভেবেছিল দোলনাতে লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে মাসার মৃত্যু হবে, কিন্তু হ্যারিকে জীবিত দেখে তাদের ধারণা হল ভূতের ওঝার চাইতে মাসা অনেক বড়ো জাদুকর।
এমন ক্ষমতাশালী জাদুকর সহায় থাকলে আর ভয় কীসের? অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়ে মজুরের দল কাজে লেগে গেল।
তারপরেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা।
দোলনাতে লাথি মারার এক সপ্তাহের মধ্যেই হ্যারি দেখলেন, তার ডান হাতের মধ্যম আঙুলটি ভীষণ ফুলে উঠেছে, সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে দারুণ যন্ত্রণা।
হ্যারি নিকটবর্তী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। ওই চিকিৎসকটি শ্বেতাঙ্গ নন, চিকিৎসাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এক স্থানীয় অধিবাসী। দোলনাঘটিত ব্যাপারটি ইতিমধ্যেই উক্ত নিগ্রো চিকিৎসকের কানে এসেছিল, আঙুলের চিকিৎসা না-করে তিনি হ্যারিকে ওঝার সঙ্গে মিটমাট করার পরামর্শ দিলেন।
বিজ্ঞানসম্মত ইউরোপীয় পদ্ধতিতে সুপণ্ডিত এক নিগ্রো চিকিৎসকের কাছে হ্যারি এমন ব্যবহার আশা করেননি। হ্যারি চিকিৎসা করার জন্যই চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন, উপদেশ চাইতে আসেননি। চটে-মটে তিনি স্থানত্যাগ করলেন। স্থানীয় নিগ্রো বন্ধুরাও হ্যারিকে বার বার ওঝার সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু হ্যারি কারুর কথায় কান দিলেন না। তার আঙুলের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হতে লাগল।
ওই সময়ে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে আবির্ভূত হল এক দারুণ সংক্রামক জ্বরব্যাধি। সংক্রামক জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নিগ্রো পল্লি ছেড়ে হ্যারি ফ্রি-টাউন শহরে উপস্থিত হলেন এবং সেখানকার মিলিটারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হলেন।
হ্যারিরও জ্বর হয়েছিল। প্রায় চার মাস পরে সুস্থ হয়ে তিনি কার্যস্থলে ফিরে গেলেন। তার আঙুলটা কিন্তু মিলিটারি হাসপাতালের নিপুণ চিকিৎসাকেও পরাজিত করল, আঙুলের ক্ষত কিছুতেই আরোগ্য লাভ করল না। হ্যারি ডান হাতটাকে একটা কাপড়ে বেঁধে গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতেন।