চুপ করো!–প্রফেসর চমকে উঠলেন, বিশ্রাম নাও। কথা বলবে না। সব ঠিক আছে। আমি আর বিল তোমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
আত্তিলিও হাতের ওপর ছুঁচ ফোঁটার যন্ত্রটা অনুভব করলেন–ইঞ্জেকশন। আলোটা নিভে গেল। দু-জোড়া পা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল তাবুর বাইরে। দু-চোখের পাতার নিদ্রার স্পর্শ সমগ্র অনুভূতি ও চৈতন্যকে অবলুপ্ত করে নামছে নিবিড় অন্ধকার… আত্তিলিও ঘুমিয়ে পড়লেন…
একমাস পরে নভেম্বরের ২১ তারিখে প্রফেসর রায় দিলেন আত্তিলিও এইবার স্বচ্ছন্দে কাজকর্ম করতে পারেন। বিগত একমাস গত্তি সাহেবকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়নি, দুই বন্ধু তাকে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছিলেন। প্রফেসরের ঘোষণা শুনে মহা উৎসাহে আত্তিলিও অনেকদিন পরে ম্যাপ খুলে বসলেন। ম্যাপটার গায়ে এক জায়গায় খুব বড়ো করে একটা ফুটকির চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। চিহ্নিত স্থান হচ্ছে সেই গুহা, যেখানে একমাস আগে আত্তিলিও অতিকায় পাইথনের দেখা পেয়েছিলেন। চিহ্নটার পাশে কে যেন পেনসিল দিয়ে লিখে রেখেছে : শুক্রবার ১৩ অক্টোবর। শুভদিন। হুররে!
শুভদিন, না ঘোড়ার ডিম!–আত্তিলিও বলে উঠলেন, আবার হুররে লিখে আনন্দ জানানো হয়েছে! কেন? এত আনন্দ কীসের?
দেখো, দেখো, ভালো করে দেখো। বিল গর্জন করে উঠল।
আত্তিলিও ভালো করে দেখলেন, সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক–কী!
এইবার আত্তিলিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। সুদীর্ঘ বিশ্রাম হৃত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় যে সময়টা তিনি অতিবাহিত করেছেন সেই সময়ে বিল আর প্রফেসর পরিদর্শন করেছেন গুহার পর গুহা। যেসব এলাকা দেখা হয়ে গেছে, সেখানে ফুটকির চিহ্ন। চিহ্নগুলোকে লক্ষ করলে দেখা যায়, কেবল পূর্ব ও দক্ষিণেই ফুটকির ছড়াছড়ি। ফুটকিগুলো সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা জায়গাকে বৃত্তের আকারে ঘিরে ধরেছে। একটু অসমান আর খাপছাড়া হলেও ফুটকিগুলো মোটামুটি একটা সরলরেখার রূপ ধরেই এগিয়েছে এবং বৃত্তের আকারে যে-স্থানটিকে ঘিরে ফেলেছে, সেটা সুগোল না হলেও বৃও বটে। ওই বৃত্তাকার স্থানটির চারপাশেই ফুটকি-চিহ্ন দেখে বোঝা যায় ওই জায়গাটা এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ফুটকিগুলো সোজা এগিয়ে এসে যেখান থেকে ঘুরে অনাবিষ্কৃত অঞ্চলটাকে নির্দিষ্ট করছে, সেই চিহ্নর বেষ্টনী শুরু হয়েছে ঠিক পাইথনের গুহার পর থেকে। অর্থাৎ পাইথনের গুহা অবধি সোজাসুজি এগিয়েছে অভিযাত্রীরা, কিন্তু উক্ত গুহার পরবর্তী স্থানে পদার্পণ করেই তারা বামে ও দক্ষিণে ঘুরে গেছেন। কিন্তু কেন? হ্যাঁ, ঘুরে যাওয়ার কারণটা বেশ স্পষ্ট। চিহ্নিত স্থানের লিখিত তারিখ দেখলেই বোঝা যায় পাইথনের গুহার পর থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা বিল আর প্রফেসরকে বাঁয়ে আর ডাইনে নিয়ে গেছে, সরলরেখা ধরে তাদের এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। ক্রমাগত বাঁয়ে আর ডাইনে ঘুরেছেন তারা, ফলে আবিষ্কৃত স্থানগুলোতে ফুটকির চিহ্ন পড়ে পরিত্যক্ত জায়গাটাকে বৃত্তের আকারে পরিস্ফুট করেছে ম্যাপের ওপর।
স্পষ্টই বোঝা যায়, ওই জায়গাটার উপর প্রফেসর আর বিলের উপস্থিতি পছন্দ করে না মাম্বোয়ারা, তাই তারা প্রফেসর ও বিলকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। আরও শোনা গেল আত্তিলিও যখন বিশ্রাম নিতে বাধ্য হয়ে বিছানায় শুয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন, সেই সময় বিল আর প্রফেসরকে সাহায্য করার জন্য রোজই এসেছে মাম্বোয়া-সর্দার স্বয়ং–দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ওই জায়গাটা থেকে অভিযাত্রীদের দূরে রাখার জন্য তার প্রচেষ্টা দুই বন্ধুই লক্ষ করেছেন। প্রফেসর ও বিলের মনোভাব বুঝতে পারেনি মাম্বোয়া-সর্দার; কারণ, সব বুঝেও কিছু না-বোঝার অভিনয় করেছেন দুই বন্ধু আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে তার ফলেই মানচিত্রের গায়ে ফুটকি-চিহ্ন বেষ্টিত গোল জায়গাটা ধরা পড়েছে।
ম্যাপের উপর ওই গোল চিহ্নবিহীন জায়গাটা দেখতে দেখতে আত্তিলিওর গলা থেকে একটা অস্ফুট অর্থহীন শব্দ বেরিয়ে এল। প্রফেসর হাসলেন, হ্যাঁ, ওইখানেই আছে–কোনো সন্দেহ নেই এ-বিষয়ে।
দারুণ উৎসাহে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। কায়না সম্বন্ধে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, এখন আবার আশায় উদ্দীপনায় তার রক্তে উৎসাহের জোয়ার লাগল। প্রফেসরের ওষুধের চাইতে ম্যাপের চিহ্নগুলো তার স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি উপযোগী হয়েছে সন্দেহ নেই।
পরের দিন সকালে সবাই যখন বেরিয়ে গেল, আত্তিলিও তখন জামানিকে ডেকে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। আত্তিলিও বুঝেছিলেন জামানির সাহায্য ছাড়া তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে তিনি জামানির সামনে প্রলোভনের জাল ফেলতে শুরু করলেন, সেইসঙ্গে জুলু জাতির স্বাভাবিক মর্যাদাবোধ ও অহংকারে সুকৌশলে আঘাত দিয়ে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা চলল… আত্তিলিও কি বোঝেন না, জামানি তার দেশ জুলুল্যান্ডে ফিরে যেতে চায়? এই। হতভাগা মাম্বোয়াদের দেশ আর ভালো লাগে না সে-কথাও তিনি জানেন। তিনি নিজেই কি এই দেশ পছন্দ করছেন? মোটেই না, মোটেই না। তবে কাজ শেষ না-করে তো এই পাথুরে-নরক ছাড়ার উপায় নেই। জামানি যদি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে চায়, তবে তারও উচিত হবে তাকে সাহায্য করা; কারণ কার্যসিদ্ধি হলেই তো তিনি চটপট এখান থেকে সরে পড়তে পারবেন। আর আত্তিলিওর যে অপেরা হ্যাট টুপিটার মধ্যে দারুণ সব জাদুবিদ্যা লুকানো আছে বলে জামানি বিশ্বাস করে, সেই টুপিটা তো জামানিকেই উপহার দিতে চাইছেন তিনি। তবে এমন একটা মূল্যবান উপহারের বিনিময়ে তারও কি মাসাংগাকে সাহায্য করা উচিত নয়?… কায়না-আবিষ্কারের পর আত্তিলিও নিশ্চয়ই তাকে জুলুল্যান্ডে নিয়ে যাবেন, সমস্ত জুলুল্যান্ডের মানুষ অবাক হয়ে দেখবে–হ্যাঁ, একটা পুরুষের মতো পুরুষ বটে জামানি।