অকাট্য যুক্তি। তবু আত্তিলিও বন্ধুদের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। আত্তিলিও শেষ চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমি স্বকর্ণে শুনেছি একজন মাম্বোয়ার কথা। লোকটা তার সঙ্গীকে বলছিল আমরা নাকি কখনোই সেদিকে যাইনি যেদিকে আমাদের গতিবিধি মাম্বোয়া-প্রধানরা পছন্দ করে না।
বিল বলল, খুব সম্ভব আমাদের অজ্ঞাতে কায়নার সামনে দিয়ে আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আসল জায়গাটা ছাড়িয়ে মাম্বোয়াদের সঙ্গে আমরা অন্যদিকের গুহায় গুহায় ঘুরেছি। এই দশ বছর ধরে ঘোরাঘুরি করলেও আমরা মৃত্যুগহ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারব না।
ঠিক আছে–আত্তিলিও বললেন, যেসব গুহাতে খনিজদ্রব্য বা ঐতিহাসিক বস্তুর নিদর্শন আছে বলে মনে হয়, তোমরা সেইসব গুহাতে সন্ধান চালিয়ে আবিষ্কারের সম্মান লাভ কর তোমাদের আমি কায়নার পিছনে সময় নষ্ট করতে বলব না। সঙ্গে যত খুশি লোক নাও, তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এতদিন ধরে এত কষ্ট সহ্য করার পর এত তাড়াতাড়ি আমি হাল ছাড়তে রাজি নই। অন্তত আরও একমাস আমি দেখব। নির্দিষ্ট একমাসের মধ্যে যদি কোনো ফল না-পাই, তাহলে কথা দিচ্ছি আমি কায়না অভিযানে ইস্তফা দেব।
আত্তিলিওর প্রস্তাবে কারো আপত্তি হল না। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।
পরের দিন ১৫ সেপ্টেম্বর স্বয়ং মাম্বোয়া-সর্দার আত্তিলিও সাহেবের সঙ্গী হল। ইতিপূর্বে সর্দার তাদের উপদেশ, নির্দেশ দিয়েছে, কোথায় কোন পথে গেলে নূতন নূতন গুহার সন্ধান পাওয়া যাবে জানিয়েছে, কিন্তু সে ব্যক্তিগতভাবে কখনো অভিযাত্রীদের সঙ্গী হয়নি। খুব সম্ভব সে বুঝেছিল, অভিযাত্রীরা শীঘ্রই তাদের দেশ ছেড়ে বিদায় নেবেন।
সর্দারের সঙ্গে কয়েকজন মাম্বোয়া অনুচর ছিল। তারা সকলেই বিভিন্ন গুহার সন্ধান দিয়ে আত্তিলিওকে সাহায্য করতে চাইল। উৎসাহের আধিক্যে আত্তিলিও সেদিন তেরোটা নূতন গুহা পরিদর্শন করে ফেললেন। একদিনে এতগুলো গুহা অভিযাত্রীদের মধ্যে কেউ ইতিপূর্বে পরিদর্শন করতে পারেননি। চোদ্দো নম্বর গুহাটার মুখে যখন আত্তিলিও পদার্পণ করলেন তখন সন্ধ্যা প্রায় আগত, অস্পষ্ট অন্ধকারের প্রলেপ পড়েছে পৃথিবীর বুকে।
আত্তিলিও চোদ্দো নম্বর গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। সঙ্গীরা গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
গুহার মধ্যে তখন অস্পষ্ট অন্ধকার।
আত্তিলিও চমকে দেখলেন, আবছা আলো-আঁধারের ভিতর থেকে তার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক বিরাট সৰ্পৰ্দানব পাইথন!
এত মোটা আর এত লম্বা সাপ কখনো দেখেননি আত্তিলিও। চকিতে রাইফেল তুলে তিনি গুলি চালালেন। পাইথনের মাথা উড়ে গেল ছিন্নভিন্ন হয়ে, কিন্তু তার মুণ্ডহীন বিরাট শরীরটা মৃত্যুযাতনায় আত্তিলিওর চারপাশে আছড়ে পড়তে লাগল একটা অতিকায় চাবুকের মতো!
আত্তিলিও অনায়াসে ছুটে পালাতে পারতেন, কিন্তু তার বুদ্ধিভ্রংশ হল। সেইখানে দাঁড়িয়েই তিনি বার বার গুলি চালিয়ে সরীসৃপের অন্তিম আস্ফালনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। অজগর-জাতীয় বৃহৎ সরীসৃপের দেহ মৃত্যুর পরেও বেশ কিছুক্ষণ অন্ধ আক্ষেপে কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী পাকিয়ে ছটফট করতে থাকে। এই সাপটাও ছিল বিরাট–তার চামড়া ছাড়িয়ে পরে যখন মাপ নেওয়া হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল পাইথনটার দৈর্ঘ্য হচ্ছে আটত্রিশ ফুট এবং দেহের সবচেয়ে স্থূল জায়গাটার মাপ হচ্ছে তিন ফুট নয় ইঞ্চি!
এত মোটা, এত লম্বা একটা সর্পিল দেহ যদি চাবুকের মতো সজোরে কোনো মানুষের গায়ে আছড়ে পড়ে, তাহলে মানুষটার যে অবস্থা হয়, আত্তিলিও সাহেবেরও সেই অবস্থা হল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে ক্ষণিকের জন্য তিনি অনুভব করলেন একটা মস্ত পাহাড় যেন তার দেহের উপর ভেঙে পড়ছে! পরক্ষণেই তাঁর চৈতন্যকে লুপ্ত করে নামল মূর্ছার অন্ধকার…
.
যষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পথের নিশানা
জ্ঞান ফিরে এলে আত্তিলিও দেখলেন, তিনি তাঁবুর মধ্যে তাঁর নিজস্ব বিছানাতে শুয়ে আছেন এবং তার কপালে কাপড় ভিজিয়ে ঠান্ডা জলের প্রলেপ দিচ্ছে জামানি।
ক্লান্তিজড়িত স্বরে প্রফেসর আর বিলকে ডেকে দিতে বললেন আত্তিলিও। তাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে মহা খুশি জামানি। একগাল হেসে সে জানাল, তারা দুজনেই বাইরে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু মাসাংগার কথা বলা উচিত নয়।
আত্তিলিওর সমস্ত সত্তা আবার ডুবে গেল গভীর নিদ্রার অন্ধকারে…
দ্বিতীয়বার চোখ মেলে আত্তিলিও দেখলেন, তার মাথার কাছে একটা আলো জ্বলছে, বন্ধুরাও কাছেই আছে। প্রফেসর আত্তিলিওকে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, আত্তিলিও যদি কথা বলার চেষ্টা না-করে তবে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে তার আপত্তি নেই। অজ্ঞান হওয়ার কারণটা প্রফেসরের মুখ থেকেই শুনলেন আত্তিলিও–সর্পদানবের দেহের প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ে একটা পাথরে মাথা ঠুকে যাওয়ার ফলেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
জামানি, মাম্বোয়া-সর্দার এবং দলবল গুহার ভিতর রাইফেলের ঘন ঘন গর্জন শুনেই বুঝেছিল, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রথমে কেউ সাহস করে ভিতরে প্রবেশ করেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও তিনি যখন বেরিয়ে এলেন না, তখন জামানির অনুরোধে মাম্বোয়া-সর্দার গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে রাজি হয়। গুহার ভিতর অচৈতন্য অবস্থায় আত্তিলিওকে পড়ে থাকতে দেখে তারা তাকে তুলে আনে এবং সবাই মিলে ধরাধরি করে তার দেহটাকে বহন করে নিয়ে আসে। তাবুতে। আত্তিলিও এই পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন, কিন্তু যখন প্রফেসর জানালেন, আটদিন ধরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন, তখন চমকে উঠলেন আত্তিলিও–আটদিন! বলে কী!