লেপার্ড লাফ দিল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটল রাইফেলের গুলি। গুলি লাগল, কিন্তু শ্বাপদের গতি রুদ্ধ হল না। সশব্দে লেপার্ড এসে আছড়ে পড়ল গুহার প্রস্তর-প্রাচীরের উপর। শ্বাপদের নিশানা ভুল হয়নি, কিন্তু আত্তিলিও স্থান পরিবর্তন করেছেন বিদ্যুদ্বেগে। লেপার্ড দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার আগেই আবার গর্জে উঠল রাইফেল, গুলি জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করে তাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল।
তীব্র উত্তেজনা কেটে যেতেই আত্তিলিও ক্লান্তি বোধ করলেন। কিন্তু ওই বিপজ্জনক গুহার মধ্যে বিশ্রাম করার ইচ্ছা তার ছিল না। সুড়ঙ্গের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি দ্রুতবেগে হামাগুড়ি দিতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই গুহার বাইরে এসে প্রখর সূর্যালোকের নীচে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
জীবনে সর্বপ্রথম জামানি তার প্রভুর আদেশ অমান্য করল। সে কিছুতেই মৃত লেপার্ডের দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে রাজি হল না।
না, মাসাংগা, না,–জামানি বলল, এই জন্তুটার চামড়া আমি ছাড়াতে পারব না। এটা লেপার্ড নয়, এটা হচ্ছে লেপার্ডের দেহধারী প্রেতাত্মা! ওটার চামড়া ছাড়িয়ে নিলেই প্রেত ওই দেহ থেকে বেরিয়ে আমাকে আক্রমণ করবে। মাসাংগা! এই দেশটা ভালো নয়, আমাদের এখনই এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।
আত্তিলিও অবশ্য জামানির উপদেশে কর্ণপাত করেননি। মাঙ্গেয়াদের সন্দেহ চলে গেছে, অভিযাত্রীরা এখন তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। এই হচ্ছে অনুসন্ধান-কার্য চালানোর উপযুক্ত সময়, এখন কি ফিরে যাওয়া যায়? মাম্বোয়াদের এখন ধারণা হয়েছে, অভিযাত্রীরা কেবল গুহার ভিতর জন্তুজানোয়ার দেখার জন্যই এখানে এসেছেন। এটা অবশ্য তাদের কাছে পাগলামি, তবে এই ধরনের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতে তাদের আপত্তি নেই। সাদা মানুষরা যদি গুহার মধ্যে ঢুকে জন্তুজানোয়ারের আঁচড়-কামড় খেতে চায় এবং সেই কাজে সাহায্য করলে যদি টাকাপয়সা, সিগারেট আর নানারকম উপহার পাওয়া যায়, তাহলে তাদের সাহায্য করতে আপত্তি কী? তবে হ্যাঁ, কায়নার কথা না-বললেই হয়।
অবশ্য অভিযাত্রীরা কায়নার নাম আর ভুলেও উচ্চারণ করতেন না।
একদিন হঠাৎ দুটি মাম্বোয়ার কথা আত্তিলিওর কানে এল। আত্তিলিও ছিলেন তাঁবুর ভিতরে, মাম্বোয়ারা তাকে দেখতে পায়নি। তিনি শুনলেন একজন মাম্বোয়া বলছে, খুব সম্ভব যে পাঁচটা ছেলে আগে সাদা মানুষের কাজ করত, তারা ভুল করেছে। বোধ হয় ওরা সাদা মানুষের কথা বুঝতে পারেনি।
তার সঙ্গী বলল, হতে পারে। কিংবা হয়তো ওটা ছিল সাদা মানুষের ক্ষণিকের খেয়ালমাত্র। তবে সেই খেয়াল কেটে গেছে, আমরা এখন যেদিকে যেতে বলি ওরা সেইদিকেই যায়। ওরা যেদিকে গেলে আমাদের মাতব্বররা বিপদ হবে বলে মনে করে, সেদিকে ওরা কখনোই পা বাড়ায় না।
আত্তিলিওর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। মাম্বোয়াদের বিশ্বাস অভিযাত্রীরা মৃত্যুগহ্বর নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। মানচিত্রটা নিয়ে আত্তিলিও দাগ দিতে লাগলেন। তার পরিকল্পনা ছিল খুবই সহজ।
মাম্বোয়ারা নিশ্চয়ই কায়নার ধারেকাছে অভিযাত্রীদের উপস্থিতি চাইবে না, অতএব মৃত্যুগহ্বর যেখানে অবস্থান করছে তার থেকে দূরে দূরেই মাথোয়ারা তাদের পরিচিত করার চেষ্টা করবে। যে জায়গাগুলো একবার দেখা হয়ে যায়, ম্যাপের গায়ে সেই জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে রাখতেন অভিযাত্রীরা। ম্যাপটাতে দাগ দিতে দিতে এক সময় তারা নিশ্চয় দেখতে পাবেন, কোন এলাকাটা বাদ দেওয়া হচ্ছে। একবার যদি তাদের চোখে ধরা পড়ে, একটা নির্দিষ্ট এলাকা মাম্বোয়ারা এড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে সেই অঞ্চলটায় অভিযান চালালেই মৃত্যুগহ্বরের সন্ধান পাওয়া যাবে।
কিন্তু হা, এখানে একটা কিন্তু আছে।
যেসব এলাকায় যাওয়া হয়েছে, ম্যাপের গায়ে সেই এলাকাগুলিকে ফুটকির দাগ বসিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে; এখন পেনসিলের লাইন টেনে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন জায়গা ম্যাপের উপর চক্রাকারে ছড়িয়ে আছে, অর্থাৎ সেইসব স্থানে এখন পর্যন্ত অভিযাত্রীদের পায়ের ধুলো পড়েনি। কিন্তু সেই ছোটো ছোটো টুকরো টুকরো অনাবিষ্কৃত এলাকার পরিধি বড়ো কম নয়। এইভাবে আর কতদিন অভিযান চালানো সম্ভব? ইতিমধ্যেই অভিযাত্রীরা বেশ কয়েকবার বিপদে পড়েছেন। অজানা গুহার অন্ধকারে অনিশ্চিত প্রত্যাশায় দিনের পর দিন জীবন বিপন্ন করা কি বুদ্ধিমানের কাজ? তিন মাস তো হয়ে গেল, আর কত দিন?
অতএব পরামর্শ সভা বসল।
প্রফেসর এবং বিল অভিযান চালানোর বিপক্ষে রায় দিলেন। প্রফেসরের বক্তব্য হচ্ছে : তিন মাস অনুসন্ধান চালিয়ে এক-শো উনত্রিশটা গুহার ভিতর তারা পদার্পণ করেছেন, কিন্তু মৃত্যুগহ্বর এখন পর্যন্ত তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। কায়নার অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রফেসর মোটেই নিঃসন্দেহ নন। তিনি আরও জানালেন এই অঞ্চলের বিভিন্ন গুহার মধ্যে প্রাচীন গুহামানবের বসবাসের নিদর্শন এবং বিবিধ প্রকার খনিজবস্তুর অস্তিত্ব তাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিয়েছে। অথচ এইসব দিকে চোখ না-দিয়ে অর্থ আর সময়ের অপব্যয় করা হচ্ছে এক অলীক বস্তুর পিছনে! অতএব এই অভিযান এখনই বন্ধ করা উচিত।
বিলও প্রফেসরকে সমর্থন জানাল, দুজনেরই মত হচ্ছে : চুলোয় যাক কায়না। মরীচিৎকার পিছনে ছুটে এসে অনেক বস্তুর সান্নিধ্য আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি, যেগুলো প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাণীবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিরাট আবিষ্কার বলে গণ্য হতে পারে।