হঠাৎ একবার পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল বমবো এবং হোঁচট খেয়ে পড়ল মাটির উপর। সে একবার ওঠার চেষ্টা করেই নিশ্চল হয়ে গেল, আত্তিলিও দেখলেন তার ভয়ার্ত চক্ষু তারকার নির্নিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে তাঁরই পিছন দিকে!
বমবোর স্তম্ভিত দৃষ্টির হেতু নির্ণয় করার জন্যে আত্তিলিও একবারও পিছন পানে চাইলেন না, তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ওঠ! ওঠ!
বমবো উঠল না।
ওঠ–
ক্রুদ্ধ হস্তীর তীব্র বৃংহণ ভেসে এল পিছন থেকে, আত্তিলিওর মনে হল তার কানের পর্দা বুঝি ফেটে গেল।
এবার আর পিছন ফিরে না-তাকিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি, সঙ্গেসঙ্গে তাঁর অবস্থাও হল বমবোর মতো–সম্মোহিত মানুষের স্তম্ভিত দৃষ্টি মেলে তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন এক ভয়ংকর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য!
নিদারুণ ক্রোধে সংহার-মূর্তি ধারণ করেছে ক্ষিপ্ত গজরাজ, কিন্তু সে এখনও অবস্থান করছে। খাদের বিপরীত পার্শ্বে! বাধাটাকে ডিঙিয়ে আসার চেষ্টা না-করে খাদ পার হওয়ার কোনো সেতুপথ আছে কি না সেইটাই এখন তার অনুসন্ধানের বিষয়। পারাপারের পথ আবিষ্কার করতে
-পেরে নিষ্ফল আক্রোশে গাছগুলোকে সে সবেগে উৎপাটিত করে নিক্ষেপ করছে ভূমিপৃষ্ঠে, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র কর্ণভেদী বৃংহণ শব্দে কঁপছে আকাশবাতাস!
আচম্বিতে অরণ্যের অন্তঃপুর থেকে ভেসে এল বহু হস্তীর কণ্ঠ-নিঃসৃত ভয়ংকর ধ্বনি, দলপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে আসছে দানবের দল! কিছুক্ষণ পরেই তাদের দেখা পাওয়া গেল। ঢালু জমির উপর দিয়ে দলপতিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল ধূসরবর্ণ চলন্ত পর্বতের সারি–আত্তিলিও গুনে দেখলেন সেই ভয়ংকর বাহিনীতে অবস্থান করছে দু-দু-শো বন্য হস্তী।
ব্যাপারটা শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয় বটে, কিন্তু ক্রোধোন্মত্ত হস্তীযুথের সামনে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাদের সংখ্যা গণনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও। নিষ্ফল ক্রোধে চিৎকার করে আকাশ ফাটালেও হাতিদের মধ্যে কেউ খাদ ডিঙিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতে রাজি নয়!
আত্তিলিওর মনে পড়ল খুব ছোটোবেলায় একটা বইতে তিনি পড়েছিলেন–প্রতি পদক্ষেপে খুব বেশি হলে সাড়ে ছয় ফুট জায়গা অতিক্রম করতে পারে হাতি; একটা সাত ফুট চওড়া খাদ পার হওয়ার ক্ষমতা তার নেই।
কেতাবি তথ্য নিয়ে আর মাথা ঘামাননি তিনি। কিন্তু কথাটা যে সত্যি সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে খাদটাকে দুটো তুচ্ছ মানুষ লাফিয়ে পার হয়ে গেছে, সেই খাদটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমিত বলশালী হস্তীযুথের সামনে! হাতি লাফাতে পারে না এবং সাড়ে ছয় ফুটের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে পা ফেলার ক্ষমতাও তার নেই–অতএব দশ ফুট চওড়া খাদের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আত্তিলিও নিজেকে বেশ নিরাপদ মনে করলেন।
কিন্তু এই নিরাপত্তা যে নিতান্ত সাময়িক সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল বমবো।
আত্তিলিও যখন হাতিদের সংখ্যা নির্ণয় করতে ব্যস্ত, বমবো তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল, গুলি চালাও বাওয়ানা, গুলি চালাও।
মাঝখানে খাদের বাধা থাকায় হাতির পক্ষে গুলি খেয়ে প্রতি-আক্রমণ চালানোর সুযোগ ছিল না। ভালো শিকারি সর্বদাই শিকারকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিতে চায়, তাই একতরফা সুবিধা নিয়ে গুলি চালাতে অনিচ্ছুক ছিলেন আত্তিলিও–কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য তিনি রাইফেল তুলতে বাধ্য হলেন। বিশালকায় যূথপত দাঁতের আঘাতে মাটি আর পাথর তুলে ফেলছে খাদের গর্তে, সঙ্গীরাও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে একাগ্রচিত্তে যেকোনো সময়ে মাটি ও পাথরে ভরাট হয়ে খাদের উপর হাতিদের পারাপার করার উপযোগী একটা সেতু গড়ে উঠতে পারে এবং সে-রকম কিছু ঘটলে গোটা দলটাই যে ওই পথে খাদ পার হয়ে মানুষ দুটিকে আক্রমণ করতে ছুটে আসবে, সে-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখাতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি হলেন না আত্তিলিও, রাইফেল তুলে সর্দার-হাতির মাথার উপর তিনি লক্ষ্য স্থির করতে লাগলেন। বিলের গুলিতে চিহ্নিত ক্ষতস্থানের একটু উপরেই আত্তিলিওর নিক্ষিপ্ত প্রথম গুলির দাগ; ওই দাগের একটু উপরে বিধল রাইফেলের দ্বিতীয় বুলেট। হাতি একটুও কাবু হল না, আঘাতের যাতনায় সে আরও কেঁপে গেল এবং দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁত বসিয়ে মাটি তুলে ফেলতে লাগল খাদের মধ্যে। আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন–এ কেমন হাতি? মাথার উপর দুর্বলতম স্থানে ভারী রাইফেলের গুলি অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এমন হাতির কথা তিনি কখনো শোনেননি। মাথা ছেড়ে তিনি নিশানা করলেন কর্ণমূলে।
গর্জে উঠল রাইফেল। হাঁটু পেতে বসে পড়ল মত্ত মাতঙ্গ। উপবিষ্ট অবস্থায় তার দেহটা একবার দুলে উঠল, তারপর প্রচণ্ড শব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির উপর–সব শেষ!
যূথপতির মৃত্যু দেখে থমকে গেল হাতির দল। শূন্যে কয়েকবার রাইফেলের আওয়াজ করলেন আত্তিলিও। হস্তীযূথ এইবার শঙ্কিত হল। প্রথমে রণে ভঙ্গ দিল শাবকসহ হস্তিনীর দল, তারপর তাদের অনুসরণ করে বনের মধ্যে অদৃশ্য হল সমগ্র বাহিনী। অকুস্থলে পড়ে রইল কেবল যূথপতির প্রকাণ্ড প্রাণহীন দেহ। বিল, মাততানি এবং আরও অনেক শিকারি ও স্থানীয় মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী খুনি জানোয়ারটা শেষ পর্যন্ত আত্তিলিওর রাইফেলের গুলিতে ইহলীলা সংবরণ করল।