শুকনো গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য ঝরনার কাছে গেলেন আত্তিলিও আর বমবো। খাদটাকে তারা ডিঙিয়ে যাননি, প্রায় বিশ ফুট খাড়াই ভেঙে ওঠানামা করে তারা ঝরনার কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
কিন্তু জলপান করতে গিয়ে তারা চমকে উঠলেন–আশেপাশে ভিজে জমির উপর ফুটে উঠেছে বহু হাতির পায়ের চিহ্ন! সেই পায়ের ছাপগুলোর ভিতর থেকে তিন আঙুলের প্রকাণ্ড পদচিহ্নটি আত্তিলিওর দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করল অতি সহজেই। একটু আগেও তার আচরণে সতর্কতার চিহ্নমাত্র ছিল না, চলার পথে বমবোর সঙ্গে তিনি মাঝে মাঝেই কথা বলছেন–এখন পায়ের ছাপগুলো দেখামাত্র তার মনে হল অতর্কিতে মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
সূর্যরশ্মি অত্যন্ত প্রখর; মেরুদণ্ডের উপর ঘর্মস্রোতের অস্বস্তিকর অনুভূতি। নিস্তব্ধ বনভূমির ভিতর থেকে ভয়ংকর শব্দের আভাস–সত্যিই কি শব্দ হয়েছে? না, মনের ভ্রম?… এতক্ষণ হাতির সাক্ষাৎ লাভ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও, এখন তার মনে হল এত তাড়াতাড়ি জন্তুটার সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হয়। শিকারির মন এখনও তৈরি হয়নি, আর একটু সময় পাওয়া দরকার…।
আত্তিলিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টিকে চালিত করলেন। পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া দরকার। অবস্থাটা তার ভালো লাগছে না–সামনে পশ্চিম দিকে বিরাজ করছে নিবিড় অরণ্য। উত্তর ও দক্ষিণে মুক্ত প্রান্তরের উপর টুকরো টুকরো পাথরের ভিড়, পূর্বদিকে অর্থাৎ তাঁদের পিছনে হাঁ করে আছে গভীর খাদ।
ওই দেখো, সভয়ে আঙুল তুলে দেখাল বমবো।
সচমকে নির্দিষ্ট দিকে ঘুরলেন আত্তিলিও। সশব্দে দুটি বৃক্ষকে ধরাশায়ী করে অরণ্যের অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে এক অতিকায় হস্তী! এক নজর তার দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও বুঝলেন এই জন্তুটাই বিলের হত্যাকারী। বহুদিন আফ্রিকায় বনেজঙ্গলে ঘুরেছেন আত্তিলিও, কিন্তু এমন প্রকাণ্ড হাতি কখনো তার চোখে পড়েনি।
সম্পূর্ণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আত্তিলিও আর বমবো। জন্তুটা ফাঁকা মাঠের উপর শিকারিদের থেকে প্রায় ২০০ ফুট দূরে অবস্থান করছিল। আত্তিলিও জানতেন হাতি দূরের জিনিস
ভালোভাবে দেখতে পায় না, অতএব এখনও তার নজরে পড়ার ভয় নেই।
কিন্তু হাওয়া? শিকারিদের দিক থেকে হাতির দিকেই ছুটে যাচ্ছে হাওয়া। অতিকায় জন্তুটা শুড় তুলে সন্দেহজনকভাবে বাতাস পরীক্ষা করছে এবং আশপাশ থেকে ভেসে-আসা শব্দের তরঙ্গ ধরার চেষ্টায় সবেগে দুলে দুলে উঠছে বিশাল দুটি কান–হাতির ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রখর। আত্তিলিও বুঝলেন তারা ফাঁদে পড়েছেন। দোষ তাঁর। বমবো অনভিজ্ঞ, সে শিকারি নয়–ড্রাইভার। তা ছাড়া বমবো যেখানকার অধিবাসী সেই অঞ্চলে হাতি নেই, উক্ত পশুটির স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে তাই সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে। আত্তিলিও যদি আর একটু সতর্ক হতেন তাহলে বিপদকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর শরীরী প্রতিচ্ছবি…
আত্তিলিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দানব আবার জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করতে উদ্যত হয়েছে। বিপদের মুখ থেকে উদ্ধার পেয়েছেন মনে করে আত্তিলিও যখন ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ শূন্যে শুড় তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াল অতিকায় হস্তী–আত্তিলিও বুঝলেন জন্তুটা তাঁদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে।
শিকারিদের বাঁ-দিক থেকে খুব ধীরে ধীরে ঢালু জমি বেয়ে আসতে লাগল হাতি, সঙ্গেসঙ্গে কান দুলিয়ে সন্দেহজনক শব্দ ধরার চেষ্টাও চলল।
আত্তিলিও রাইফেল তুললেন কাঁধে।
হাতি আরও এগিয়ে এল। চোখে না-দেখলেও ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে সে জেনে গেছে শিকারিরা কোথায় আছে।
দানবের চলার গতি বাড়ল। কমে আসতে লাগল দানব ও মানবের মধ্যবর্তী দূরত্ব।
নব্বই ফুট। আত্তিলিওর পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। আশি ফুট। সর্বাঙ্গে আতঙ্কের শিহরন, বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডের গতি বুঝি থেমে যেতে চায়–রাইফেলের নিশানা স্থির করলেন আত্তিলিও।
সত্তর ফুট। মাথার মাঝখানে দুই চোখের একটু উপরে একটা ক্ষতচিহ্ন। বিলের গুলি ওইখানে কামড় বসিয়ে দাগ করে দিয়েছে।
ষাট ফুট। বিল তো হাতির মর্মস্থানে গুলি চালিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার! হাতিটা এখনও বেঁচে আছে কী করে? ..
পঞ্চাশ ফুট। বিল যেখানে গুলি করেছে সেই জায়গাটা থেকে এক ইঞ্চি উপরে আমি গুলি চালাব। মনে মনে ভাবলেন আত্তিলিও।
চল্লিশ ফুট। প্রকাণ্ড দুই গজদন্ত উদ্যত জিঘাংসায় প্রসারিত। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকেই দাঁত দুটো শিকারিদের দেহে বিদ্ধ হবে।
ত্রিশ ফুট। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলের ছাপ। কর্কশ শব্দ, আগুনের ঝলক। তীব্র তীক্ষ্ণ বৃংহণ-ধ্বনি। হাতি থমকে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু রাইফেলের বুলেট তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারেনি।
পালাও, বাওয়ানা!
আবার জাগল গজকণ্ঠে ভয়ংকর ধ্বনি। শব্দ এগিয়ে আসছে। আত্তিলিও পিছন ফিরে পলায়মান বমবোকে অনুসরণ করলেন। বমবো এক লাফে খাদ পার হয়ে গেল। মুহূর্তের দ্বিধা দশ ফুট ফাঁকটা কি পার হওয়া যাবে? পরক্ষণেই এক প্রচণ্ড লক্ষ্যে শূন্যপথ অতিক্রম করে খাদের বিপরীত পার্শ্বে এসে পড়লেন আত্তিলিও।
ছুট! ছুট! ছুট! সামনে বমবো, পিছনে আত্তিলিও! সুদীর্ঘ শুণ্ড আর প্রকাণ্ড দুই গজদন্তের মারাত্মক স্পর্শের আশঙ্কায় পলাতকদের সর্বাঙ্গে আতঙ্কের শিহরন–যেকোনো মুহূর্তে ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে ক্রোধোন্মত্ত হস্তী।