বিলের দলিত ও ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ হাসপাতালের গাড়িতে তুলে দিতে গেলেন আত্তিলিও। জিজ্ঞাসা করে ডাক্তার জানতে পারলেন আত্তিলিও এখন ওই হাতিটাকে অনুসরণ করবেন।
হ্যাঁ, জন্তুটা আমার বন্ধুকে হত্যা করেছে, আত্তিলিও বললেন, রক্তের ঋণ আমি রক্তেই শুধব। কিন্তু আপনি এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
গাড়িটাকে তাহলে আমি এখনই আবার পাঠিয়ে দেব, ডাক্তার বললেন, হয়তো আর একটা মৃতদেহকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হবে!
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অরণ্য-ভৈরব
বুধবার সকালে বিল এবং মাতোনির মৃতদেহ পেয়েছিলেন আত্তিলিও। সেদিনই অর্থাৎ বুধবারে, রাতের দিকে বমবো এসে জানাল জাটার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রাম এখনও জনমানবশূন্য। আত্তিলিওর দলভুক্ত অভিযাত্রীদের মধ্যে যে চারজন নিগ্রো ছিল, তারা সাগ্রহে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। কিন্তু আত্তিলিও তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলেন অভিযানের বিভিন্ন কাজে দক্ষ হলেও এই অরণ্য তাদের পরিচিত নয়, অতএব লোকগুলোর প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। বুঝেই তাদের নিবৃত্ত করা হল।
বৃহস্পতিবার সকালে আত্তিলিওর দলবল বায়রা ছেড়ে অন্যত্র যাত্রা করল। আত্তিলিও অবশ্য তখন তাদের সঙ্গ গ্রহণ করেননি, কথা হল পরে তিনি তাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। বিলের সৎকার-কার্যে তিনি উপস্থিত ছিলেন, মহা সমারোহের সঙ্গে তাকে কবর দেওয়া হল। হাসপাতালে গিয়ে ম্যরিয়ার সাক্ষাৎ লাভ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। চেষ্টা সফল হয়নি; চিকিৎসকরা জানালেন যদিও মেয়েটির অবস্থা খুব খারাপ নয়, তবু লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা এখন চলবে না। আত্তিলিও জেনে খুশি হলেন যে, ম্যরিয়ার গর্ভস্থ শিশু বেশ ভালোই আছে।
সমস্ত কর্তব্যের পালা চুকিয়ে আত্তিলিও চললেন হন্তারক হস্তীর সন্ধানে, সঙ্গে ড্রাইভার বমবো। হত্যাকাণ্ড যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সেখানকার মানুষ যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু এবার পুলিশের সাহায্যে গ্রামের সর্দারকে পাকড়াও করলেন আত্তিলিও। পুলিশ-অফিসার ঘোষণা করল সর্দার যদি আত্তিলিওকে হাতির সন্ধান পেতে সাহায্য না করে, তাহলে তাকে পদচ্যুত করে সেই জায়গায় অন্য সর্দারকে নিযুক্ত করা হবে।
তারপর এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে তাই হল। বিলের হত্যাকারী হস্তী এবং তার দলবল সম্বন্ধে সর্দারের ছিল অপরিসীম আতঙ্ক। আতঙ্ক অহেতুক নয়–পুলিশ যা-ই করুক, খুন করবে না; কিন্তু সাদা শিকারির গুলি যদি ফসকে যায় তাহলে উক্ত হস্তীবাহিনীর দলপতি হয়তো গ্রামের উপর হানা দিতে পারে এবং সে-রকম ঘটনা ঘটলে বহু মানুষ যে প্রাণ হারাবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অতএব সর্দার নানাভাবে আত্তিলিওকে ভুলপথে চালিত করতে সচেষ্ট হল।
কায়না নামক মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে গিয়ে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি বুঝেছিলেন, স্থানীয় মানুষ কেমন করে বিদেশিকে দিগভ্রান্ত করে দেয়। সর্দারের চালাকি খাটল না, কয়েকদিনের মধ্যেই আত্তিলিও পূর্বোক্ত হস্তী ও তার দলবলের সন্ধান পেয়ে গেলেন।
পায়ে-চলা বনপথের উত্তর দিকে অবস্থিত জলাভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আত্তিলিও সর্দারকে বললেন, কাল আমি ওইদিকে যাব। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। আমি জানি ওইখানেই আছে সেই শয়তান।
আচমকা মুখের উপর চড় মারলে মানুষের যে অবস্থা হয়, সর্দারের মুখের অবস্থাও হল সেইরকম। স্খলিতস্বরে সে বলল, সাদা মানুষ! তুমি মরবে। তমার আগে অনেক কালো আর সাদা শিকারি ওই জন্তুটাকে মারতে গিয়ে মরেছে। তুমিও তাদের মতো মরবে।
আত্তিলিও বুঝলেন তাঁর অনুমান যথার্থ। ওইখানেই আছে বিলের হত্যাকারী।
কাল আমরা যাচ্ছি, আত্তিলিও ঘোষণা করলেন। পুলিশ অফিসার ভয় দেখিয়ে যে-কথাটা বলেছিল, সেই কথাটাও তিনি সর্দারকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুললেন না।
অবশ্য পুলিশের কাছে সর্দারের সম্বন্ধে অভিযোগ করেননি আত্তিলিও। যতদূর জানা যায় আত্তিলিও সাহেবের বায়রা ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত উক্ত সর্দারকে সর্দারি করতে দেখা গেছে। ঘটনাটা অন্যরকম হতে পারত–কারণ, পরের দিন সকালে আত্তিলিও আর সর্দারকে দেখতে পাননি। এক রাতের মধ্যে সে এলাকা ছেড়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। মুখে যাই বলুন, মনে মনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেননি আত্তিলিও। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি?
সর্দারের অনুপস্থিতি শিকারীর সংকল্পে বাধা দিতে পারল না। বমবোকে সঙ্গে নিয়ে জলাভূমি পার হলেন আত্তিলিও। তিনি অনুমান করেছিলেন স্যাঁৎসেঁতে জলাভূমির পরেই শক্ত মাটির দেখা পাওয়া যাবে। অনুমানে ভুল হয়নি–জলার সীমানা শেষ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রস্তর-আবৃত কঠিন ভূমি, এখানে ওখানে ফাঁকা জায়গার উপর বিচ্ছিন্নভাবে মাথা তুলেছে সবুজ উদ্ভিদের সারি এবং ছোটো বড়ো পাথরের টুকরো। একটা উঁচু জায়গার উপর উঠে জলের কল্লোলধ্বনি শুনতে পেলেন আত্তিলিও। উচ্চভূমির পরেই একটা খাদ। বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে চলে গেছে সেই খাদ ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়। দু-পাশে খাড়া মাটির দেয়াল-বসানো ফঁকটা দশ ফুটের কম নয়। খাদের বিপরীত দিকে একটা ঝরনা দেখতে পেলেন আত্তিলিও। ওই ঝরনার শব্দই তিনি শুনেছেন একটু আগে।