আত্তিলিওর সম্বিৎ ফিরে এল যখন তিনি দেখলেন ম্যরিয়ার দেহ রক্তচিহ্নিত মাটির উপর লুটিয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি ছুটে এসে তিনি মূর্তি বন্ধুপত্নীর পতনোন্মুখ দেহটাকে ধরে ফেললেন। এতক্ষণে সন্ধানপর্ব শেষ! সামনেই মাটির উপর জমাট শুষ্ক রক্তের ছড়াছড়ি এবং সেই শোণিত-চিহ্নিত ভূমিতে পড়ে আছে দুটি বিকৃত, নিষ্পিষ্ট, ছিন্নভিন্ন মনুষ্যদেহ বিল আর মাততানি!
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রক্তের ঋণ রক্তেই শুধব
আত্তিলিও চিৎকার করে বমবোকে বললেন সে যেন এখনই শহর থেকে ডাক্তার, নার্স আর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে। জাটা নামক নিগ্রোটিকে তিনি বমবোর পথপ্রদর্শক হয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চটপট শহরে পৌঁছানোর পথ স্থানীয় মানুষের নখদর্পণে, তাই বমবোর সঙ্গে জাটাকে যেতে বলেছিলেন আত্তিলিও। তার মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই বিদ্যুদবেগে অন্তর্ধান করল বমবো আর জাটা। মূৰ্ছিতা ম্যরিয়াকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন আত্তিলিও প্রাণহীন জড় পদার্থের মতো…
অনেকক্ষণ পরে লোকজন নিয়ে হাজির হল বমবো। ম্যরিয়ার অচেতন দেহটাকে বমবো আর আত্তিলিও ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলে দিলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানালেন স্নায়ুর উপর অত্যধিক চাপ পড়ার ফলে মেয়েটি জ্ঞান হারিয়েছে, কিন্তু ভয়ের কারণ নেই–সে নিশ্চয়ই আরোগ্য লাভ করবে। ম্যরিয়াকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটল শহরের হাসপাতাল অভিমুখে।
এইবার ভালোভাবে অকুস্থল পর্যবেক্ষণ করলেন আত্তিলিও। হস্তীযুথের পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত মৃত্তিকার বুক শুষ্ক রক্তের অক্ষরে যে শোচনীয় কাহিনির বর্ণনা ফুটে উঠেছিল, সেটা অনভিজ্ঞের কাছে দুর্বোধ্য হলেও ঝানু শিকারির চোখে সেই চিহ্নগুলো ছিল ছাপানো বইয়ের অক্ষরের মতোই স্পষ্ট–অতএব অকুস্থল পরিদর্শন করার পর আর প্রকৃত ঘটনা আত্তিলিওর অজ্ঞাত রইল না।
শহর থেকে আগত ডাক্তারটির প্রশ্নের জবাবে আত্তিলিও বললেন, মানুষ আর হাতির পায়ের ছাপ দেখে সহজেই বুঝতে পারছি জন্তুটার মগজ লক্ষ করে বিল গুলি চালিয়েছিল। খুব সম্ভব চিৎকার করে যুথপতিকে প্ররোচিত করেছিল বিল। হাতিটা তাকে লক্ষ করে ছুটে আসতেই বিল গুলি ছুঁড়েছিল। মগজের যে-জায়গায় আঘাত লাগলে হাতির মৃত্যু অবধারিত, সেই দুর্বল স্থানটির উপরে ও নীচে অবস্থান করছে কঠিন হাড়ের দুর্ভেদ্য আবরণ। অপ্রত্যাশিতভাবে মস্তক সঞ্চালন করার ফলেই বোধ হয় হাতির মর্মস্থান থেকে একটু দূরে গুলি লেগেছিল এবং ক্রোধে ও যাতনায় ক্ষিপ্ত দানব এসে পড়েছিল বিলের দেহের উপর। এই ধরনেরই একটা ব্যাপার ঘটেছিল সন্দেহ নেই। বিল ছিল লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, নিতান্ত দুর্ভাগ্যবশত তার নিশানা ব্যর্থ হয়েছে।
অতঃপর আত্তিলিও ঘটনার যে বিশ্লেষণ করলেন তা হচ্ছে এই–
বিল দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর সুযোগ পায়নি। যূথপতিকে অর্থাৎ বিলের আততায়ীকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল মাতোনি। তার নিক্ষিপ্ত গুলিও ক্ষিপ্ত হস্তীর গতি রোধ করতে সমর্থ হয়নি। হাতিদের দলপতি যখন বিলের দেহের উপর ক্রোধ চরিতার্থ করছিল, তখন দৌড়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল মাততানি–দুঃখের বিষয় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ছুটে এসেছিল শরীরী ঝটিকার মতো ক্রুদ্ধ হস্তীযুঞ্চ এবং মাততানির দেহটাকে পিষে দলে আবার প্রবেশ করেছিল অরণ্যের গর্ভে। অকুস্থলের নিকটস্থ ভূমিতে একটি স্থানীয় মানুষের পদচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন আত্তিলিও। খুব সম্ভব ওই লোকটির কাছে খবর পেয়েই গ্রামবাসীরা সতর্ক হয়েছিল। পুলিশের ভয় তো ছিলই, কিন্তু পুলিশের চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর মত্ত মাতঙ্গের আক্রমণ আশঙ্কা করেই গ্রাম ছেড়ে বনের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছিল গ্রামের মানুষ।
আত্তিলিও যখন ওইভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করছিলেন তখন ডাক্তারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল ড্রাইভার বমবো। সে জানাল আত্তিলিওর অনুমান অভ্রান্ত। জাটা নামক পূর্বে উল্লিখিত যে লোকটি যাত্রীদের অকুস্থলে নিয়ে এসেছিল, সে নিজেই ছিল বিলের পথপ্রদর্শক। মাততানির সঙ্গে জাটার বন্ধুত্ব ছিল; মাতোনির পরিবর্তে তার বন্ধু জাটা বিলকে হাতিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল–দুর্ঘটনার স্থলে নিকটবর্তী ভূমিতে জাটার পায়ের ছাপই দেখেছেন আত্তিলিও। বমবো বেশ বুদ্ধিমান লোক, ওইসব দরকারি খবর সে এখানে এসে জোগাড় করে ফেলেছে কিছুক্ষণের মধ্যে।
আত্তিলিও সাহেবও একটি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন বিলের আততায়ীর একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি এখন সম্পূর্ণ সচেতন। আফ্রিকার হাতির সামনের দুটি পায়ে চারটি আঙুল, পিছনের পায়ে তিনটি–কিন্তু বিলের হত্যাকাণ্ডের জন্য যে খুনি হাতিটা দায়ী, সেই জন্তুটার সামনের বাঁ-পায়ে চারটির পরিবর্তে রয়েছে তিনটি আঙুল। অসংখ্য হাতির পদচিহ্নের ভিতর থেকে অপরাধীকে খুঁজে নিতে এখন আর অসুবিধা নেই শুধু তিন আঙুলের বৈশিষ্ট্য নয়, এমন গভীর ও বৃহৎ পদচিহ্ন আগে কখনো আত্তিলিওর চোখে পড়েনি। পায়ের ছাপ দেখেই আত্তিলিও বুঝতে পারলেন আফ্রিকার অতিকায় হস্তীকূলেও বিলের হত্যাকারীর মতো প্রকাণ্ড হস্তী নিতান্তই দুর্লভ। ।
শয়তান, আত্তিলিও সক্রোধে প্রতিজ্ঞা করলেন, তোমাকে আমি শেষ করব।