.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পথের শেষে
গাড়ি ছুটছে। দীর্ঘ পথ। যাত্রীরা মৌন। দুশ্চিন্তা ও উদবেগ যাত্রীদের নির্বাক করে রেখেছে। শুধু চালনচক্রের ওপর অভ্যস্ত দক্ষতায় ঘুরছে ড্রাইভার বমবোর হাত।
যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। সংকীর্ণ পথের উপর এক জায়গায় পড়ে ছিল একটা গাছ। অনেক কষ্টে সেই বাধা ভেদ করে গাড়ি ছুটল। জোর করে সঙ্গে আসার জন্য বন্ধুপত্নীর উপর বিরক্ত হয়েছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু ক্রোধ প্রকাশ করে লাভ নেই–ম্যরিয়া অটল, অবিলম্বে বিলের খবর পাওয়ার জন্য যেকোনো বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে প্রস্তুত।
নির্দিষ্ট স্থানে ৩২নং মাইলপোস্টের কাছ রাস্তা থেকে একটু দূরে ফাঁকা জায়গার উপর তাঁবুটা যাত্রীদের দৃষ্টিগোচর হল। তাঁবুতে ঢুকে বিলের দেখা পাওয়া গেল না।
আত্তিলিও ম্যরিয়াকে জানালেন শয্যার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমিয়ে সকাল বেলা বেরিয়ে গেছে, খুব সম্ভব এখনই সে মাতোনিকে নিয়ে ফিরে আসবে। ম্যরিয়াকে যাই বলুক না কেন বিলের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আত্তিলিওর মনেও তখন সংশয় উপস্থিত বিছানাতে বিলের দেহের ছাপ থাকলেও সে যে কখন শয্যাত্যাগ করেছে সে-কথা অনুমান করা সম্ভব নয়।
আত্তিলিওর প্রবোধ বাক্য শুনে খুশি হল না ম্যরিয়া, সত্যিকার অবস্থাটা সে জানতে চায় ধাতুনির্মিত যে বাক্সটার মধ্যে বিল খাবারদাবার নিয়ে এসেছিল সেই বাক্সের ডালা খুলে মেয়েটি ভিতরে দৃষ্টিপাত করল। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কের চমক! সব কিছুই অটুট অবস্থায় আছে, একটুকরো খাবারও বাক্স থেকে অদৃশ্য হয়নি! অর্থাৎ তিনদিন আগে এখানে পৌঁছেই হাতির পিছু নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে বিল আর মাততানি, ফিরে এসে খাদ্যগ্রহণের সুযোগ হয়নি বলেই তাদের খাদ্যসামগ্রী অটুট ও অক্ষত অবস্থায় যথাস্থানে বিরাজ করছে! তিনদিন নিখোঁজ তারা!
ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে মানুষ যেমন করে প্রিয়জনের শবাধারের ডালা বন্ধ করে, ঠিক তেমনি করেই বাক্সের ডালা বন্ধ করল ম্যরিয়া। এতক্ষণ পরে মেয়েটির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। বিলের নাম ধরে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠে সে লুটিয়ে পড়ল পরিত্যক্ত শয্যায়, তার দুই চোখ বেয়ে নামল তপ্ত অশ্রু।
আত্তিলিওর জীবনে এমন দুঃসহ রাত্রি কখনো আসেনি। শোকের প্রথম আবেগ কেটে যেতেই ম্যরিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে, দারুণ আশায় বুক বেঁধে বার বার ছুটে এসেছে পথের উপর আবার নিরাশ হৃদয়ে স্থলিত পদক্ষেপে প্রবেশ করেছে তাঁবুর মধ্যে। সমস্ত রাত এবং পরের দিন সকাল পর্যন্ত সে ওইভাবেই কাটিয়েছে। ওই দীর্ঘসময়ের মধ্যে কোনো খাদ্য তো দূরের কথা, এক কাপ চা পর্যন্ত পান করতে রাজি হয়নি ম্যরিয়া। বার বার অনুরোধ করেও তাকে কিছুই খাওয়াতে পারলেন না আত্তিলিও। এক রাতের মধ্যে তিন-তিনবার নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা হয়েছে, হতচকিত গ্রামবাসীরা বিমূঢ়ভাবে ঘাড় নেড়েছে না, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা তাদের চোখে পড়েনি।
দিনের আলো ফুটতেই আবার অনুসন্ধান শুরু হল। একটার পর একটা গ্রাম পরিদর্শন করলেন আত্তিলিও আর ম্যরিয়া। সবসুদ্ধ প্রায় পাঁচ-ছয়টা গ্রামে তারা পদার্পণ করেছেন, সব জায়গায় একই উত্তর–সাদা চামড়ার কোনো মানুষের খবর জানে না স্থানীয় মানুষ। অবশেষে ৩৪নং মাইলপোস্টটার কাছে এসে যে-গ্রামটাকে তারা দেখলেন, সেটা ছিল সম্পূর্ণ জনশূন্য।
গ্রাম পরিদর্শন করে যাত্রীরা বুঝলেন দু-দিন আগেও সেখানে লোকজন বাস করত। হঠাৎ গৃহত্যাগ করে গ্রামসুদ্ধ লোকের বনের ভিতর উধাও হওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পেলেন না আত্তিলিও। কিন্তু ম্যরিয়া দৃঢ়ভাবে জানালেন জনশূন্য গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিলের অন্তর্ধান রহস্য। তার ধারণা গ্রামের মধ্যে খুব শীঘ্রই মানুষের দেখা পাওয়া যাবে।
ম্যরিয়ার চিন্তাধারা যে অভ্রান্ত সে-কথা প্রমাণিত হল বুধবার সকাল দশটার সময়ে।
ধূলিধূসর ক্লান্ত দেহে বিস্তর ঘোরাঘুরির পর আবার ৩৪নং মাইলপোস্টের কাছে ফিরে এসে যাত্রীরা পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্যে একটি মনুষ্যমূর্তির সাক্ষাৎ পেলেন। পূর্বোক্ত মনুষ্যটি কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করছিল, সাদা চামড়ার সামনে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা তার ছিল না। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কিছুমাত্র মর্যাদা না-দিয়ে ড্রাইভার বমবো লোকটিকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে যাত্রীদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। লোকটি স্থানীয় মানুষ, নাম–জাটা। জাটা চোখে-মুখে আতঙ্কের চিহ্ন পরিস্ফুট। প্রথমে সে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি, কিন্তু ম্যরিয়ার অবস্থা দেখে তার মনে সহানুভূতির উদ্রেক হল। আতঙ্কের পরিবর্তে স্নিগ্ধ কোমল অভিব্যক্তির ছায়া পড়ল জাটার মুখে, চলো।
সম্মোহিতের মতো জাটাকে অনুসরণ করল ম্যরিয়া। প্রায় ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর একটা ফাঁকা জায়গার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল স্থানীয় মানুষ, তার উদবিগ্ন দৃষ্টি এখন আত্তিলিওর দিকে। হঠাৎ জাটার পাশ দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল ম্যরিয়া। এত তাড়াতাড়ি সে চালিয়েছিল যে, আত্তিলিও কিংবা নিগ্রোটি তাকে বাধা দেবার সুযোগ পেলেন না।
নারীকণ্ঠের অবরুদ্ধ আর্তস্বর শোনা গেল; আত্তিলিও ছুটে গেলেন ম্যরিয়ার দিকে। পরক্ষণেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি, কয়েক মুহূর্তের জন্য আড়ষ্ট হয়ে গেল তার সর্বাঙ্গ।