আমাদের কাহিনির নায়ক স্বয়ং আত্তিলিও সাহেবও সঙ্গীদের মতোই গুহার ভিতর বিপন্ন হয়েছিলেন।
সিংহ নয়, হায়না নয়, একটি ছোটো গোলাকার মাংসপিণ্ডের রোমশ শরীরের উপর হোঁচট খেয়ে আত্তিলিও প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। একদিন বিকেল বেলা আত্তিলিওর বিশ্বস্ত অনুচর জামানি তাকে একটা সুড়ঙ্গের সামনে এনে জানাল ওটা একটা গুহার প্রবেশপথ। পথটা ছিল নীচু, খুবই সংকীর্ণ। অতি কষ্টে ভিতরে প্রবেশ করলেন আত্তিলিও, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। অনেকক্ষণ ওইভাবে চলার পর তার মনে হল এতক্ষণে বোধ হয় তিনি সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে গুহার ভিতর পৌঁছেছেন। হাতের টর্চ জ্বেলে তিনি দেখলেন তার অনুমান সত্য–বিজলিবাতির ক্ষীণ আলোকধারা হারিয়ে গেছে এক অন্ধকার-আচ্ছন্ন গুহার বিপুল বিস্তৃতির মধ্যে। ওই বিশাল গুহার অভ্যন্তরে পদার্পণ করলে প্রস্তরবেষ্টিত গলিপথগুলোর ভিতর পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে, অতএব ভিতর দিকে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ হবে কি না ভাবতে লাগলেন আত্তিলিও এবং ভাবতে ভাবতেই হামাগুড়ি-দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পায়ের উপর সেই বস্তুটির অস্তিত্ব অনুভব করলেন! সঙ্গেসঙ্গে গুহার শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জেগে উঠল একটা শব্দ ফাসস! পরক্ষণেই জুতোর চামড়ার উপর ধারালো বস্তুর সংঘাতের শব্দ!
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – জ্ঞান হারালেন আত্তিলিও
টর্চের আলোটা তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে পায়ের উপর ফেলে আত্তিলিও দেখলেন, তার জুতোর সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে হলুদের উপর কালো কালো ছাপ-বসানো একটা রোমশ ফুটবল! সেই অতিজীবন্ত ও অতি ক্রুদ্ধ ফুটবলের মতো গোলাকার বস্তুটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে মার্জারকণ্ঠের গর্জনধ্বনি, সঙ্গেসঙ্গে জুতোর উপর ধারালো নখের আঁচড় কাটার শব্দ।
লেপার্ডের বাচ্চা! বিড়াল জাতীয় জীবের স্বভাব অনুযায়ী বাচ্চাটা সমস্ত দেহটাকে গোল করে পাকিয়ে আত্তিলিওর জুতোটাকে চেপে ধরেছে এবং তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে মোটা হান্টিং বুট-এর চামড়া!
বাচ্চাটার চেষ্টা সফল হত কি না বলা মুশকিল, কিন্তু আত্তিলিও তাকে সেই সুযোগ দিলেন না। সজোরে লাথি মেরে বাচ্চাটাকে তিনি দূরে সরিয়ে দিলেন। জন্তুটার ছিটকে পড়ার আওয়াজ, শোনা গেল। অন্ধকার গুহার গর্ভে শ্বাপদ-শিশুর ছোটো শরীরটা আত্তিলিওর দৃষ্টিগোচর হল না, কিন্তু রুষ্ট প্রতিবাদ ভেসে এল তার কানে–ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে বাচ্চাটা তার বিরক্তি ও ক্রোধ জানিয়ে দিচ্ছে!
আচম্বিতে সেই শব্দে সাড়া দিয়ে গর্জে উঠল আরও অনেকগুলো বাচ্চা লেপার্ড : ফ্যাঁস, ফ্যাঁস, ফ্যাঁসস…।
অন্ধকারের ভিতর শ্বাপদ শিশুদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না আত্তিলিও, কেবল তাদের ক্রুদ্ধ বিড়ালের মতো গর্জনধ্বনি তার কানে ভেসে আসতে লাগল।
আত্তিলিও ভয় পেলেন।
অনেকটা লেপার্ডের মতো দেখতে চিতা নামক যে-জন্তুটি আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করে, সেই চিতার বাচ্চা দেখলে তিনি ভয় পেতেন না; কিন্তু আত্তিলিওর অভিজ্ঞ চক্ষু ভুল করেনি, জন্তুটা চিতার বাচ্চা নয়, লেপার্ড-শিশুই বটে। চিতা ভীরু জানোয়ার, লেপার্ড হিংস্র ও ভয়ংকর। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো লেপার্ড মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক, বিশেষ করে বাচ্চার বিপদের আশঙ্কায় অন্ধকার গুহার ভিতর ক্ষিপ্ত লেপার্ড-জননীর আক্রমণ যে কতখানি মারাত্মক হতে পারে, সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিওর মতো দুঃসাহসী মানুষও ভয় পেয়েছিলেন।
তিনি বুঝেছিলেন, দিনের বেলা অন্ধকার গুহার আশ্রয় ছেড়ে বাচ্চাদের মা বড়ো লেপার্ডটা বাইরে বেড়াতে যাবে না–সে নিশ্চয়ই গুহার ভিতরে কোথাও অবস্থান করছে এবং বাচ্চাদের নিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্যে যে দ্বিপদ জন্তুটি তার আস্তানায় অনধিকার প্রবেশ করেছে, তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আত্তিলিও বাচ্চাদের মা বড়ো লেপার্ডটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু অন্ধকারে অভ্যস্ত একজোড়া শ্বাপদচক্ষু যে তার গতিবিধি লক্ষ করছে, সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিও অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিলেন।
বাচ্চাগুলো ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দে এতক্ষণ ক্রোধ প্রকাশ করছিল, হঠাৎ তারা একসঙ্গে চুপ করে গেল। আত্তিলিওর অনুমান এইবার নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হল : বাচ্চাদের আকস্মিক নীরবতা বড়ো লেপার্ডটার সান্নিধ্য প্রমাণ করে দিয়েছে।
পালাতে পারলে আত্তিলিও পালিয়েই যেতেন। কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময়ে আক্রান্ত হলে অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ করতে হবে, আত্মরক্ষার চেষ্টা করাও সম্ভব হবে না। অতএব পলায়নের চিন্তা ছেড়ে গুহার ভিতর দাঁড়িয়ে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তিনি প্রস্তুত হলেন। গুহার দেয়ালে পিঠ রেখে আত্তিলিও টর্চের আলো ঘুরিয়ে বড়ো লেপার্ডটাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
হঠাৎ তার মাংসপেশিগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেল–দুটো বিরাট পাথরের মাঝখানে টর্চের আলোকধারার মধ্যে ভেসে উঠেছে একজোড়া বৃহৎ নিস্পলক চক্ষু!
চোখ দুটো গোল, সবুজ এবং জ্বলন্ত!
মা-লেপার্ড!
বিপদের মুখোমুখি হতেই বিপদের ভয় কেটে গেল। আত্তিলিওর কম্পিত হাত দুটো হঠাৎ সৈনিকের অভ্যস্ত দৃঢ়তায় রাইফেল ও টর্চ আঁকড়ে ধরল, টর্চের আলোতে জ্বলন্ত চোখ দুটির উপর নিশানা স্থির করতে লাগলেন আত্তিলিও।