আত্তিলিও দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ভবি ভোলবার নয়!…
বিল যেদিন চলে গেল সেদিনটা ছিল শনিবারের সকাল। ম্যরিয়া খুব সপ্রতিভ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে দুশ্চিন্তা ও উদবেগের আভাস আত্তিলিওর কাছে গোপন থাকেনি। শুধু কণ্ঠস্বর নয়, বন্ধুপত্নীর মুখ-চোখে সংশয় ও আশঙ্কার চিহ্ন দেখেছিলেন আত্তিলিও। শিকারের সরঞ্জাম নিয়ে বিল ছিল ব্যস্ত ও উত্তেজিত, স্ত্রীর ভাবান্তর সে লক্ষ করল না।
যাওয়ার আগে বন্ধুকে শেষবারের মতো নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন আত্তিলিও। অন্তত এই হাতিটার পিছু নিতে বিলকে তিনি নিষেধ করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা অকারণ নয়–মাতোনির কাছ থেকে এর মধ্যেই পূর্বোক্ত হস্তীর দৈহিক আয়তন ও স্বভাবচরিত্রের যে বিবরণ আত্তিলিওর কর্ণকুহরে পরিবেশিত হয়েছিল তাতে বন্ধুর নিরাপত্তা সম্বন্ধে শঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিল হেসে জানিয়েছিল তাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা করতে সে সমর্থ। ওই ভয়ংকর জীবের পশ্চাদ্ধাবনের সংকল্প থেকে বিলকে নিরস্ত করতে না-পেরে আত্তিলিও তার সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
বিল তার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, ধন্যবাদ। কিন্তু আমি জানি কালই তোমার বায়রা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেছে। অকারণে কারো কাজের ক্ষতি হয় তা আমি চাই না। আমার জন্য দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। আমি জানি কী করে হাতি মারতে হয়। দুই চোখের একটু উপরে একটা সরলরেখার মধ্যে অবস্থিত দুর্বল জায়গাটা কমলালেবুর মতো বড়ো–ওইখানে গুলি বসাতে পারলে হাতির নিস্তার নেই। ত্রিশ ফুটের বেশি দূরত্ব থেকে গুলি চালানো উচিত নয়; অতএব হাতি তেড়ে এলে স্থিরভাবে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এসে পড়ে নির্দিষ্ট পাল্লার মধ্যে–তাই নয় কি? এসব ব্যাপার আমি জানি। খেপা জানোয়ারের সামনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে নিশানা করার ক্ষমতা যে আমার আছে সে-কথা তো তোমার অজানা নয়। অতএব বন্ধু, ভয়ের কোনো কারণ নেই।
বিল চলে গেল। আত্তিলিও কর্মসূচি বদলে ফেললেন। যদিও জরুরি কাজে পরের দিনই তার অন্যত্র যাওয়ার কথা, কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল কাজটা এমন কিছু দরকারি নয় যে এই মুহূর্তে হইহই করে ছুটতে হবে–বরং বিল ফিরে এলে তার সঙ্গে দেখা করে যাওয়াই বিবেচনার কাজ। স্থানত্যাগের পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে বায়রাতেই থেকে গেলেন আত্তিলিও এবং টেলিফোন করে ম্যরিয়াকে জানিয়ে দিলেন বিল ফিরে আসার আগে তিনি এই জায়গা ছেড়ে কোথাও নড়ছেন না।
তোমার চিন্তার কারণ নেই, আত্তিলিও বললেন, বিল যেকোনো সময়ে ফিরে আসতে পারে।
না! না! হঠাৎ টেলিফোনের ভিতর দিয়ে ম্যরিয়ার অস্বাভাবিক কণ্ঠ তীব্রস্বরে ফেটে পড়ল আত্তিলিওর কানে, ও আর আসবে না!
আত্তিলিও স্তম্ভিত! আবার ভেসে এল নারীকণ্ঠের দ্রুত উক্তি, ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! আচ্ছা, গুড নাইট।
আত্তিলিও ভাবলেন ম্যরিয়া তার কথা বুঝতে পারেনি, সে বোধ হয় ভেবেছে সেই রাতেই বিলের ফিরে আসার কথা বলছেন তিনি, সেইজন্যই এই প্রতিবাদ। অর্থাৎ তার বক্তব্য হচ্ছে এত তাড়াতাড়ি বিল ফিরে আসতে পারে না।
ম্যরিয়া কী বলতে চেয়েছিল তা সঠিকভাবে অনুধাবন করলেন আত্তিলিও মঙ্গলবার দুপুরে। সেদিন মধ্যাহ্নভোজের পর একটি ছোটোখাটো দিবানিদ্রা দেবার উদ্যোগ করছেন আত্তিলিও, এমন সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন।
ফোন তুলতেই ম্যরিয়ার কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে চলে আসুন। আত্তিলিও হতভম্ব, সেকী! কী হয়েছে?
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদিক থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল। ম্যরিয়া ফোন রেখে দিয়েছে।
নিশ্চয় বিল আহত অবস্থায় ফিরে এসেছে, আত্তিলিও ভাবলেন। তিনি জামাকাপড় পরে নিজস্ব গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার বমবো গাড়ি চালিয়ে উপস্থিত হল বিলের বাড়িতে। ম্যরিয়া মাথায় হেলমেট চড়িয়ে বারান্দার উপর থেকে পথের দিকে তাকিয়েছিল। কোনো ভূমিকা না-করে সে আত্তিলিওকে বলল, বিলের কিছু হয়েছে।
কেন? বিলের কোনো খবর পেয়েছ?
খবর পাইনি বলেই বুঝতে পারছি কিছু হয়েছে। বিল কথা দিয়েছিল সোমবারের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবে। আজ মঙ্গলবার, অথচ তার দেখা নেই। কিন্তু এখন কথা বলার সময় নয়, চলুন আমরা যাই। তর্ক করবেন না, দয়া করে চলুন। এক্ষুণি চলুন। এই মুহূর্তে।
আত্তিলিও বোকার মতো বললেন, কোথায় যেতে হবে তা তো জানি না।
উত্তর এল, আমি জানি। রেনল্ট। ভিলা মাচাডোর রাস্তায় যেতে হলে রেনল্টে যেতেই হবে। ওখানকার গাঁয়ের মানুষের কাছে নিশ্চয়ই ওর খবর পাওয়া যাবে।
আত্তিলিও বন্ধুপত্নীকে বাড়িতে অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানালেন এবং তিনি যে এই মুহূর্তে অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে যথাসম্ভব শীঘ্র ম্যরিয়াকে প্রয়োজনীয় সংবাদ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করবেন সে-কথা জানাতেও ভুললেন না। কিন্তু ম্যরিয়া বাড়ি থাকতে রাজি নয়।
আমি খাবারদাবার তৈরি রেখেছি। পানীয় জল, কম্বল, ফ্ল্যাশ-লাইট প্রভৃতি সব কিছুই সাজানো আছে। বিলের বাড়তি বন্দুকটাও সঙ্গে নিচ্ছি–হয়তো অস্ত্রটা ব্যবহার করার দরকার হতে পারে। আর এক মিনিটও নষ্ট করা উচিত নয়। চলুন।
আত্তিলিও বুঝলেন ম্যরিয়া কোনো কথা শুনবে না, সে যাবেই যাবে। অগত্যা বন্ধুপত্নীকে নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার বমবো গাড়ি ছুটিয়ে দিল।