মিনিট দুই পরেই বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে মিলিত হলেন আত্তিলিও। শুরু হল করমর্দনের পালা, তুবড়ির মতো ছুটল বাক্যস্রোত। অভিযানের সাজসরঞ্জাম নৌকা থেকে ডাঙার উপর নামল; সেগুলোকে ভালোভাবেই আত্তিলিও তদারক করলেন, ফাঁকে ফাঁকে তবু কথাবার্তার বিরাম নেই। বিল এবং তস্য পত্নী নিজস্ব গাড়ি চালিয়ে আত্তিলিওকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল, পথে গাড়ির মধ্যেও চলেছে অবিরাম বাক্যের স্রোত। মধ্যাহ্নভোজের সময়েও আলাপের পালা অব্যাহত, সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ঘনিয়ে এল তখনও কথার শেষ নেই–অবশেষে আত্তিলিও যখন তার লোকজনের কাজকর্ম পরিদর্শন করতে শুল্কবিভাগে ছুটলেন তখনই শেষ হল অবিশ্রান্ত বাক্যের ফুলঝুরি। বিলের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাই এর মধ্যে শুনেছেন আত্তিলিও। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিম্নে বর্ণিত হল।
জুলুল্যান্ড থেকে প্রফেসর আর মাততানির সঙ্গে বায়রা শহরে আসার পথে প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনো হাতিকে পরলোকে পাঠানোর সুযোগ পায়নি বিল। তারা যখন বায়রোতে এসে পৌঁছাল, তখন রাজনৈতিক আবহাওয়া খুব খারাপ। ইউরোপের বুকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনা পর্তুগিজ উপনিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। প্রফেসরকে তার মাতৃভূমি অর্থাৎ ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন ফরাসি দূতাবাসের কর্তৃপক্ষ। বিলের হাতে তখনও বেশ কিছু টাকা, সময়ও প্রচুর–অতএব নূতন উদ্যমে আবার হাতির সন্ধানে জঙ্গলের দিকে যাত্রার করার জন্য প্রস্তুত হল বিল। বিল নির্ঘাত হাতির পিছনেই তাড়া করত, কিন্তু লিসবন থেকে ম্যরিয়া নামে যে-মেয়েটি বায়রাতে এসেছিল তাকে দেখে বিলের মন বদলে গেল। হাতির কথা ভুলে ম্যরিয়ার মনোরঞ্জনে সচেষ্ট হল বিল।
কিছুদিনের মধ্যেই সে জানতে পারল ম্যরিয়ার দিক থেকেও তার প্রতি অনুরাগের অভাব নেই। অতঃপর ঘটনাচক্রের অনিবার্য পরিণতি, অর্থাৎ বিবাহ। বিয়ের পর সিডনি ব্যাঙ্কে একটা দস্তুরমতো ভালো চাকরি নিয়ে ম্যরিয়ার সাহচর্যে আদর্শ দম্পতির জীবনযাপন করছিল বিল। আত্তিলিওর সঙ্গে যখন বিলের আবার দেখা হল তখন পরবর্তী সপ্তাহ থেকে একটি নয়দিন ব্যাপী ছুটি উপভোগের আনন্দে সে মশগুল।
শুল্কভবনের দিকে আত্তিলিওকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বিল গল্প করছিল। এখানকার আবহাওয়া তার এবং নববধূর স্বাস্থ্যের উপযুক্ত বলে অভিমত প্রকাশ করল বিল; সামাজিক পরিবেশ চমৎকার, স্থানীয় ক্লাবগুলোতে নানাধরনের খেলাধুলার সুযোগও আছে–পরিশেষে তার বক্তব্য হল মানুষের জীবন যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়ে কত সুন্দর হতে পারে বিয়ের আগে সে-ধারণা তার ছিল না।
বিলের কথাবার্তা এই পর্যন্ত বেশ উপভোগ করেছিলেন আত্তিলিও, অকস্মাৎ বজ্রাঘাত!
এখন আমার ছুটি, বিলের কণ্ঠস্বর আনন্দে উদবেল, হাতি শিকারের নতুন পারমিট পেয়েছি। ভিলা মাচাডো নামে যে-জায়গাটা রয়েছে, সেখানে দানবের মতো অতিকায় একটা হাতি ভীষণ অত্যাচার করছে। এবারের ছুটিতে সেই হাতিটাকেই সাবাড় করব। খবরটা দিয়েছে। মাততানি। সেও আমার সঙ্গে যাচ্ছে। কী মজা!
আবার হাতি! আত্তিলিওর মুখ শুকিয়ে গেল–সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্য আর মোটা মাইনের চাকরি বিলের মন থেকে প্রতিশোধের রক্তাক্ত সংকল্পকে মুছে ফেলতে পারেনি!
শুষ্কস্বরে তিনি বললেন, মাততানি? সে কোথা থেকে এল? তোমাদের পৌঁছে দিয়ে তার তো দেশে ফিরে যাওয়ার কথা–এতদিন সে এখানে কী করছে?
একগাল হেসে বিল জানাল সেইরকম কথাই ছিল বটে, কিন্তু মাতোনির জায়গাটা ভালো লেগে গেল বলে সে আর দেশে ফিরল না। বিল আরও বলল যে, ব্যাঙ্কের কাজে অন্তত এক সপ্তাহের ছুটি না-পেলে শিকারে যাওয়া অসম্ভব; সেইজন্যই সে এতদিন হাতিদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে একসময়ে না একসময়ে সুযোগ যে পাওয়া যাবে সে-বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল না। সেই উদ্দেশ্যেই বরাবর নিগ্রোশিকারি মাতোনির সঙ্গে সে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে। এখন নয়দিনের লম্বা ছুটি পাওয়া গেছে আর অতিকায় এক হস্তীর সংবাদও উপস্থিত, অতএব মাতোনিকে নিয়ে হস্তিনিধনের অভিযানে যাত্রা করার এমন সুবর্ণসুযোগ হেলায় হারাতে সে রাজি নয়।
আত্তিলিওর সবসময়েই মনে হয়েছে বিল আর হাতির যোগাযোগ এক অশুভ পরিণতির সূত্রপাত করবে। কোনোদিন তিনি বিলের হাতি শিকারের আগ্রহে উৎসাহ প্রকাশ করেননি। এখনও সম্ভব হলে তিনি বাধা দিতেন, কিন্তু বিল এখন তার অধীনে অভিযানকার্যে ব্যাপৃত নয়–তাকে তিনি বাধা দেবেন কী উপায়ে? একমাত্র ভরসা ম্যরিয়া।
আত্তিলিও বললেন, তুমি বলতে চাও কালই তুমি বউকে ফেলে রাইফেল ঘাড়ে হাতির পিছনে ছুটবে?… অসম্ভব। ম্যরিয়া কখনোই রাজি হবে না।
বিল সানন্দে দন্তবিকাশ করল, আজ বিকেলে আমি ম্যরিয়াকে সব কথা খুলে বলব। বিয়ের আগে ম্যরিয়া আমাকে শিকার ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিল। আমি বলেছিলাম কয়েকটা হাতিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে আমি শিকারে ইস্তফা দেব। ম্যরিয়া খুব ভালো মেয়ে। আমার প্রস্তাবে তার আপত্তি হয়নি। আমি যে এতদিন শিকারে যাইনি তার কারণ স্ত্রীর অসম্মতি নয়–ছুটি পাইনি বলেই আমি হাতি শিকারের চেষ্টা করতে পারিনি। বুঝলে বন্ধু, এবার এমন বিরাট দুটি গজদন্ত আমি তোমার সামনে নিয়ে আসব যে, তেমন জিনিস তুমি জীবনে দেখনি।