কয়েক মাসের মধ্যেই আফ্রিকাবাসী বিভিন্ন হিংস্র পশুর সম্মুখীন হল বিল। জন্তুগুলোকে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি। অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা অসম্ভব, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মরণফাঁদ থেকে অনায়াসে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে এসেছে বিল, একবার নয়, বহুবার।
ওইসব দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার-এ লিপ্ত হয়ে বিল তার কর্তব্যে কখনো গাফিলতি করেনি। ভোর হওয়ার আগেই সে বেরিয়ে যেত, ফিরে আসত প্রাতরাশের সময়ে। কখনো কখনো অভিযাত্রীদের কর্মবিরতির পরে সে জঙ্গলের পথে বেরিয়ে পড়ত নূতন অভিজ্ঞতার সন্ধানে। কঠিন পরিশ্রমের পর আত্তিলিওর দলবল যখন বিশ্রাম নিতে ব্যর্থ, বিলের উৎসাহ-বহ্নি তখনও প্রদীপ্ত! বিশ্রাম শয্যা ছেড়ে সে এগিয়ে চলেছে শিকারের খোঁজে, সঙ্গে রয়েছে আত্তিলিওর নিগ্রো পথপ্রদর্শক ও বন্দুকবাহক মাততানি!
শিকারের সন্ধানকার্যে মাতোনির দক্ষতা ছিল অসাধারণ, পথপ্রদর্শক হিসাবেও তার তুলনা হয় না। কিন্তু প্রথম বছরের শেষ দিকে সে আত্তিলিওকে চুপি চুপি জানিয়ে দিল হাতিদের সঙ্গে লম্বা মাসাংগার (মাতোনির ভাষায় বিলের নামকরণ!) দেখা হওয়াটা প্রেতাত্মাদের অভিপ্রেত নয়–অতএব যতই চেষ্টা করা যাক লম্বা মাসাংগা কখনো হাতির দেখা পাবে না!
ব্যাপারটা সত্যি বড়োই অদ্ভুত। মাততানির সঙ্গে যথাস্থানে গিয়ে হস্তীযুথের সাক্ষাৎ পেয়েই তাড়াতাড়ি হাতি শিকারের পারমিট বা অনুমতিপত্রের জন্য সচেষ্ট হয়েছে বিল এবং অনুমতিপত্র নিয়ে পূর্বোক্ত স্থানে উপস্থিত হয়ে দর্শন করেছে আফ্রিকার নিসর্গশোভা হাতিরা সেখানে অনুপস্থিত! কয়েকদিন আগেও যেখানে দলে দলে হাতি বিচরণ করেছে, সেখানে আজ একটি হাতিরও পাত্তা নেই! সব ভোঁ ভাঁ!
কিছুদিন পরেই অভিযানের কাজে অভিযাত্রীরা গেছেন আর এক অঞ্চলে। আগেকার অনুমতিপত্র এখানে অচল, কারণ এখানে রাজত্ব করছে আর এক সরকার। সেখানেও হাতিদের দেখা গেল বিল, সঙ্গেসঙ্গে চেষ্টাচরিত্র আর অর্থব্যয় করে আরও একটি পারমিট জোগাড় করল সে, কিন্তু তারপরই আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! বিলও হাতিশিকারের অনুমতি পেয়েছে আর হাতির দলও হাওয়া হয়ে গেছে সেই তল্লাট ছেড়ে! আশ্চর্য কাণ্ড!
অভিযাত্রীরা যখন মাম্বোয়া জাতির আস্তানায় কায়না বা মৃত্যুগহ্বরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত, সেই সময়ে বিলের কাছে জমেছে সাত-সাতটি হাতি শিকারের অনুমতিপত্র কিন্তু অযথা অর্থব্যয় ছাড়া কোনো লাভ হয়নি, একটিও হাতি মারতে পারেনি বিল।
কায়না অভিযানে সাফল্য লাভ করে মাম্বোয়াদের নিয়েই বিল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মাম্বোয়াদের দেশে প্রায় সবরকম শিকারই সুলভ, কিন্তু হাতিরা ওখানে বাস করে না। তা ছাড়া হাতি শিকারের পক্ষে যে-মানুষটির সাহায্য অপরিহার্য, সেই মাততানিকে আগেই মোজাম্বিক সীমান্তে দক্ষিণ রোডেশিয়াতে তার নিজস্ব গ্রামে পৌঁছে দিয়ে অভিযাত্রীরা এসেছিলেন উত্তর রোডেশিয়ার মাম্বায়া রাজ্যে–অতএব হাতির পিছনে তাড়া করার সুযোগ পেল না বিল। সকলে ভাবল বিল বোধ হয় হাতির কথা ভুলে গেছে।
কায়না অভিযানে সাফল্য লাভ করে মাম্বোয়াদের দেশ ছেড়ে অভিযাত্রীরা এলেন জুলুল্যান্ডে। আত্তিলিওর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেখানকার পরিস্থিতি বেশ ভালো প্রথমত কয়েকশো মাইলের মধ্যে হাতির বসবাস নেই, দ্বিতীয়ত নরখাদক সিংহদের নিয়ে সকলে এমন ব্যতিব্যস্ত যে অন্য বিষয়ে মাথা ঘামানো অসম্ভব। ইনিয়াতি পর্বতমালার মধ্যে জুলুদের দেশে কয়েক মাস কাটিয়ে দিলেন সবাই। এর মধ্যে একবারও বিলের মুখে হাতি শব্দটি শোনা গেল না। অবশেষে সর্দার জিপোশোর আদেশে অভিযাত্রীরা একদিন জুলুল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হলেন–প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে যে মুহূর্তে তারা জুলুল্যান্ডের বাইরের পথটার উপর এসে পড়লেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই বিলের মুখে পরিচিত শব্দটি আবার শুনতে পেলেন সকলে হাতি! বিল দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিল অভিযাত্রীরা যা খুশি করতে পারেন, যেখানে খুশি যেতে পারেন কিন্তু সে এখন হাতির সন্ধানে যাত্রা করতে বদ্ধপরিকর, অন্য কোনো বিষয়ে মাথা ঘামাতে সে মোটেই রাজি নয়। বিল আরও জানাল বায়রা থেকে লন্ডন হয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার ভাড়ার টাকা রেখে বাকি সব টাকা প্রয়োজনবশে খরচ করতে তার আপত্তি নেই–একেবারে কপর্দকশূন্য হওয়ার আগে সে হাতি শিকারের আশা ছাড়বে না।
বিলের আগ্রহ আর সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে আত্তিলিও আবার মাততানির সঙ্গে দেখা করলেন–এবং প্রফেসর আর বিলের সঙ্গে ওই নিগ্রোশিকারির বায়রা পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
তারপরই হল বিচ্ছেদ। একদিকে গেলেন আত্তিলিও অন্যদিকে বিল আর প্রফেসর। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আর বন্ধুদের খবর পাননি আত্তিলিও। দীর্ঘকাল পরে নূতন অভিযানের উদ্যোগে বায়রাতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আত্তিলিও হঠাৎ বিলের দেখা পেলেন।
বন্দরের মধ্যে যখন আত্তিলিওর নৌকা প্রবেশ করছে, সেইসময়ে একটি পর্তুগিজ লঞ্চ-এর উপর দণ্ডায়মান বিলের দীর্ঘদেহ তার নজরে পড়ল। আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন অন্তত দশ মাস আগে যার আমেরিকাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা, সেই মানুষটি এখন হাত দুলিয়ে দন্তবিকাশ করে তাকে তারস্বরে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে! তার পাশেই যে সুন্দরী তরুণীটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই আত্তিলিও বুঝলেন সে বিলের স্ত্রী।