প্রফেসর এই কাহিনিতে অনুপস্থিত, শুধু প্রসঙ্গ উঠল বলেই তাঁর নামের উল্লেখ। বিলকে কেন্দ্র করে বর্তমান বিষয়ের অবতারণা।
প্রথম পরিচয়ের সময়ে আত্তিলিও সাহেব ওই যুবকের আফ্রিকা ভ্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি। পরবর্তীকালে আত্তিলিও জানতে পেরেছিলেন অগণিত হস্তিযুথের সংখ্যাকে রাইফেলের সাহায্যে যথাসম্ভব কমিয়ে দেবার জন্যই আফ্রিকার অরণ্যে বিলের আবির্ভাব। হাতি শিকারের জন্য তার অস্বাভাবিক আগ্রহের আসল কারণটা যখন গোপন রইল না, তখন মনে মনে অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও–কিন্তু সেইসময় বিলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার উপায় ছিল না, নিয়তির নিষ্ঠুর নির্দেশে রক্তাক্ত এক পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে অমোঘ ভাগ্যচক্র।
অনেক শিকারির কাছে হাতি-শিকার নিতান্তই একটা শখ, কিন্তু বিলের ব্যাপারটা তা নয়। সমগ্র হস্তীজাতি সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করত বিল। তার বাল্যকালে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী একটি হাতি এবং সেই ঘটনাবিলের মনোরাজ্যে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা করে–শৈশব থেকে কৈশোর আর কৈশোর থেকে যৌবনের পরিণতি এক শোকার্ত শিশুর চিন্তার জগতে ধীরে ধীরে অনুভূতির জন্ম দেয়, দুঃখ-বেদনার পরিবর্তে জেগে ওঠে প্রতিহিংসার রক্ত-লোলুপ সংকল্প।
ঘটনাটা ঘটেছিল আমেরিকার ডেট্রয়েট নামক স্থানে। বিল যখন পাঁচ বছরের শিশু সেইসময় তার বাপ-মা তাকে পূর্বোক্ত স্থানে সার্কাস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সার্কাসের হাতিদের মধ্যে একটি হস্তিনী ছিল শিশুদের অত্যন্ত প্রিয়। লক্ষ লক্ষ শিশু তাকে দেখার জন্য ভিড় করত। হস্তিনীর স্বভাবচরিত্র খুবই শান্ত, বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য খোকা-খুকুর হাত থেকে বাদাম প্রভৃতি লোভনীয় খাদ্যের উপহার গ্রহণ করেছে ওই জন্তুটি, কোনোদিনই তার আচরণে উগ্রতার আভাস দেখা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে খেপে গেল–তীব্র বৃংহন-শব্দে চারদিক কাঁপিয়ে সে ছিঁড়ে ফেলল পায়ের শিকল, তারপরই শুরু হল ভয়ংকর কাণ্ড। সার্কাসের দড়ি আর বেড়া ভেঙেচুরে উড়িয়ে ছুটে চলল ক্রোধোন্মত্ত হস্তিনী, চলার পথে মানুষজন যাকে পেল তাকেই খুঁড়ে জড়িয়ে ধরে সজোরে ছুঁড়ে ফেলল এদিক-ওদিক এবং অনেকগুলো মানুষকে হতাহত করার পর সে এসে দাঁড়াল একটা মালবহনকারী শকটের সামনে। অন্ধ ক্রোধে আত্মহারা হস্তিনী তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির উপর। তার খর্বাকৃতি গজদন্ত দুটি শকট ভেদ করে গুরুভার বস্তুটিকে অতি সহজেই শূন্যে তুলে ফেলল–পরক্ষণেই শকটসমেত হস্তিনীর প্রকাণ্ড মৃতদেহ ভীষণ শব্দে গড়িয়ে পড়ল মাটির উপর! বোধ হয় হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে জন্তুটার মৃত্যু ঘটেছিল। হইহই! চিৎকার! ধুন্ধুমার!
(হস্তিনীর গজদন্তের কথা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই–এশিয়ার হাতিদের মধ্যে নারীজাতি উক্ত মহাস্ত্রে বঞ্চিত হলেও প্রকৃতির কৃপায় আফ্রিকার মহিলারা পুরুষদের মতোই দন্তসজ্জায় সুসজ্জিতা, ভয়ংকরী। বলাই বাহুল্য যে, সার্কাসের হস্তিনী ছিল আফ্রিকার জীব।)
যাই হোক, ওই গোলমালের মধ্যে বাচ্চা বিলকে তার বাপ মা-র কাছ থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে এনেছিল সার্কাসের জনৈক কর্মচারী। একটু পরেই বিল দেখতে পেল মায়ের মৃতদেহ পড়ে আছে মাটির উপর, পাশেই হাঁটু পেতে বসে আছেন বাবা। এক বছর পরেই বিলের বাবা মারা গেলেন। স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যুর শোক তাঁর আয়ুক্ষয় করে দিয়েছিল।
ওই দুর্ঘটনার তেইশ বছর পরে নিউইয়র্ক শহরে বিল আর আত্তিলিওর সাক্ষাৎকার। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিজ্ঞান বিষয়ক অভিযানকার্যে সাহায্য করার জন্য সঙ্গী হিসাবে বিলকে নির্বাচিত করেছিলেন আত্তিলিও। তার সিদ্ধান্ত জানার সঙ্গেসঙ্গে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বিলের মুখ। প্রথমেই আত্তিলিওর কাছে বিল যে-প্রশ্নটি করেছিল তার মর্ম হচ্ছে আফ্রিকাতে হাতি-শিকারের সুযোগ আছে কি না।
শুধুহাতি কেন, আত্তিলিও উত্তর দিয়েছিলেন, সিংহ, লেপার্ড, বন্য মহিষ, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি সব জানোয়ারই ওখানে বাস করে। চেষ্টা করলে গণ্ডার শিকারের সুযোগ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু, বিল জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমি হাতি মারতে চাই। জঙ্গলের পথে ঘোরাঘুরি করার কায়দাকানুন শিখে গেলে আমি কি দু-একটা হাতি শিকার করতে পারব না?
আত্তিলিও জানালেন হাতি মারতে গেলে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। বিনা অনুমতিতে আফ্রিকায় কোথাও হাতি মারতে দেওয়া হয় না, হাতি শিকারের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা দরকার। বিভিন্ন উপনিবেশের আইন অনুযায়ী অনুমতিপত্রের জন্য যে মূল্য ধার্য করা হয়, সেটা হচ্ছে বিশ থেকে পঞ্চাশ ডলারের মধ্যে। বেআইনিভাবে হাতি শিকার করলে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়ে থাকেন কর্তৃপক্ষ।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে বিল জানিয়ে দিল আইন ভঙ্গ করে হাতিশিকারে তার আগ্রহ নেই। টাকাটা কোনো প্রশ্ন নয়, হাতিশিকারের অনুমতি পাওয়ার জন্য অর্থব্যয় করতে আমি কুণ্ঠিত নই। বিলের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার আভাস, কিন্তু হাতি মারতে হলে কি খুব বেশি অভিজ্ঞতার দরকার? আর আমরা যে-অঞ্চলে যাচ্ছি সেখানে কি হাতি আছে?
আফ্রিকার যে অঞ্চলে অভিযাত্রীরা প্রথমে পদার্পণ করেছিলেন, সেই জায়গাটা হচ্ছে গজরাজ্যের প্রিয় বাসস্থান–রোডেশিয়া। শিকারের অভিজ্ঞতার জন্য বিলকে তালিম দেবার দরকার হয়নি, কারণ মাছকে কখনো সাঁতার কাটার তালিম নিতে হয় না–দক্ষ শিকারির অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়ে জন্মেছিল বিল, শিকার তার রক্তে রক্তে। দূরদর্শিতা, কষ্টসহিষ্ণুতা প্রভৃতি শিকারিসুলভ সব গুণই তার ছিল, সেইসঙ্গে ছিল তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি এবং অতি বলিষ্ঠ একজোড়া পা–দুর্গম জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বনচারী নিগ্রোরাও যখন শ্রান্ত ক্লান্ত, তখনও দৃঢ় পদক্ষেপে পথ ভেঙে এগিয়ে যেতে বিলের আপত্তি নেই। উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করলেও বিপদের সময়ে বিল সম্পূর্ণ শান্ত, সংযত, নির্বিকার।