রেডি!
কাঁধের সন্ধিস্থলে একটা তীব্র যাতনা অনুভব করলেন আত্তিলিও। পরক্ষণেই অভিশপ্ত নক্ৰসংকুল নদীগর্ভ থেকে তার দেহটা প্রবল আকর্ষণে শূন্যে উঠে এল! কাপালালো আর তার দুই সঙ্গী তাকে কী করে উদ্ধার করেছিল এবং জলের উপর দোদুল্যমান সেই বৃক্ষশাখায় ভারসাম্য বজায় রেখে কোন প্রক্রিয়ায় আত্তিলিওর অচেতন শরীরটাকে তারা শক্ত মাটির নিরাপদ আশ্রয়ে নামিয়ে এনেছিল সেই রহস্য আত্তিলিওর কাছে আজও অজ্ঞাত কারণ, নিগ্রোরা যখন তার উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত, তিনি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সব ভালো যার শেষ ভালো
এটা নাইনির গয়না, হাতির দাঁতের তৈরি, একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন আত্তিলিও, আর এই তামার ব্রেসলেট হল নাইনির বোনের সম্পত্তি। ওই ক্রস হচ্ছে পাদ্রী সাহেবের জিনিস। ।
আচ্ছন্নের মতো শুয়ে শুয়ে কথাগুলো শুনতে পেলেন আত্তিলিও। তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? স্বপ্ন কি কথা কয়? অতি কষ্টে চোখের পাতা মেলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলেন তিনি। একটা চোখ খুলল। আরেকটা খুলল না, কারণ সেই চোখটার উপর লাগানো ছিল ব্যান্ডেজ গোছের একটা আবরণ। যে-কণ্ঠস্বর মগ্নচৈতন্যের দ্বারে আঘাত করে আত্তিলিওর চেতনা ফিরিয়ে এনেছিল, সেই কণ্ঠস্বরের মালিককে সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মধ্যেও চিনতে পারলেন আত্তিলিও –মাতুংগো!
কাপালালোকেও সেখানে দেখতে পেলেন আত্তিলিও। তার তাঁবুর মধ্যে তারই বিছানার কাছে মাটির উপর দুজনে বসে ছিল। একটা ক্যানভাসের উপর পড়ে ছিল কয়েকটা জলে-ভেজা জিনিস। মেয়েদের দুটি অলংকার। একটা ক্রস। একটা পুরানো ধরনের ক্যামেরার লেন্স। একটা মস্ত সোনার ঘড়ি এবং ঘড়ির সঙ্গে আটকানো একটা ভারী সোনার চেন ইত্যাদি…
বাওয়ানা এইবার আমাদের কথা বিশ্বাস করবে। মাতুংগো বলল, সে যখন দেখবে নগুরা-গুরা চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে এই জিনিসগুলো উদ্ধার করেছে তখন আর আমাদের কথা সে অবিশ্বাস করতে পারবে না।
সে এই জিনিসগুলিকেও স্বচক্ষে দেখবে। কাপালালো বলে উঠল এবং তার হাত থেকে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি দ্রব্য এসে পড়ল মাটিতে রাখা ক্যানভাসের উপর। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা জিনিস হাতির দাঁতে তৈরি, কতকগুলো আবার ধাতব বস্তু। ওই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে নরভুক কুম্ভীরের অপরাধের অকাট্য প্রমাণ। বছরের পর বছর ধরে ওই জিনিসগুলো জমেছে ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতার উদর-গহ্বরে।
কিন্তু–আত্তিলিও জানতে চাইলেন, কুমিরগুলো কি চফু-মায়াকে খেয়ে ফেলেনি? জিনিসগুলো পাওয়া গেল কী করে?
কাপালালো আর মাতুংগো চমকে উঠল। তারা বুঝতেই পারেনি কখন আত্তিলিওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। এবার দুজনেই হেসে ফেলল।
তোমার বন্দুকের আওয়াজ শুনে গ্রামের সব লোক দৌড়ে এসেছিল, কাপালালো বলল, তারাই তোমাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। আর দড়ি ধরে টেনে চফু-মায়ার ছিন্নভিন্ন দেহটাকে তারাই তুলে এনেছে ডাঙার উপর। চফু-মায়ার পেটের ভিতর থেকে যে জিনিসগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো এখন নগুরা-গুরার সম্পত্তি। কাল সে জিনিসগুলো গ্রিক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করবে। ওগুলোর বদলে সে পাবে অনেকগুলো ছাগল।
কিছুদিন আগে মাতুংগো একটা কথা বলেছিল। সেই কথাটা হঠাৎ এখন আত্তিলিওর মনে পড়ল, যমজ বোনদের আত্মা ওদের পিতাকে খুশি করবে। ওই আত্মা দুটির কল্যাণে পিতার ধনসম্পদ বাড়বে, বৃদ্ধ বয়সে সে খুশি হবে।
মাতুংগো বেশি কথাবার্তা পছন্দ করে না। কাপালালোকে ঠেলে সরিয়ে দিল সে। এটা পান করো, সযত্নে আত্তিলিওর মাথাটা তুলে ধরে একটা কাঠের পাত্র তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল মাতুংগো।
কৃতজ্ঞচিত্তে তরল ওষুধটা পান করে ফেললেন আত্তিলিও। পানীয়টা বলকারক এবং মশলার গন্ধে পরিপূর্ণ।
ঘুমাও,মাতুংগো বলল। আত্তিলিওর মাথাটা সে আবার ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল বালিশের উপর।
ঘুমাও, বাওয়ানা, কাপালালো বলল, আর ভয় নেই। সব ভালো যার শেষ ভালো।
বৈশাখ ১৩৮০
৬. প্রতিহিংসা
সৈনিকের ষষ্ঠ অভিজ্ঞতা
প্রতিহিংসা
প্রথম পরিচ্ছেদ – রহস্যময় অন্তর্ধান!
পূর্ব আফ্রিকার পর্তুগিজ উপনিবেশ মোজাম্বিক-এর রাজধানী বায়রার ২,০০০ শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী একদিন অবাক হয়ে ভাবতে লাগল সিডনি ব্যাঙ্কে বিল নামে যে হিসাবরক্ষকটি কাজ করে সে হঠাৎ সেইদিন সকালে তার গৃহে অনুপস্থিত কেন? মাত্র তিনদিন আগে ওই শহরে যে মানুষটি পদার্পণ করেছেন, সেই আত্তিলিও গত্তি নামক নবাগত ভদ্রলোকের সঙ্গে বিলের আসন্নপ্রসবা তরুণী বধূ মারিয়ার শহর ত্যাগ করে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও অত্যন্ত রহস্যময়। আত্তিলিওর নিজস্ব গাড়িতে তাঁরই নিগ্রো ড্রাইভারের সঙ্গে মারিয়ার যাত্রা শুরু; সেই সময় যারা মেয়েটিকে দেখেছে তারা চমকে উঠেছে মেয়েটির মুখ মৃতের মতো বিবর্ণ, রক্তশূন্য!..
কমান্ডার আত্তিলিও গত্তির অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি যাঁরা প্রথম থেকে পাঠ করেছেন, তাঁদের কাছে বিল নামধারী যুবকটি অপরিচিত নয়। কিন্তু কায়নাও শয়তানের ফঁদ যাঁদের দৃষ্টিগোচর হয়নি, সেইসব পাঠকের পক্ষেও বর্তমান কাহিনির রসগ্রহণ করতে কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না, যখন তারা জানতে পারবেন যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে আত্তিলিও গত্তি নামক মিত্রপক্ষের জনৈক সৈনিকের নেতৃত্বে আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মানুষ, জীবজন্তু ও অরণ্যসম্পদ সম্পর্কে গবেষণা করতে উক্ত মহাদেশে পদার্পণ করেছিলেন দুটি শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রী–প্রফেসর, এক ফরাসি চিকিৎসক এবং বিল, এক দুঃসাহসী মার্কিন যুবক।