চফু-মায়া সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা পোষণ করলেও তার যন্ত্রণা দেখে ব্যথিত হলেন আত্তিলিও। তিনি স্থির করলেন জলের উপর আহত কুমিরটা একবার মাথা তুললেই তিনি গুলি চালিয়ে তাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দেবেন।
আচম্বিতে নদীর বুক থেকে ছিটকে এল রক্তাক্ত জলের ধারা আত্তিলিওর দিকে, সচমকে এক লাফ মেরে সরে গেলেন তিনি। ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত জলের ধারাটা নদীতটে নিঃশেষ হয়ে যেতেই আবার এগিয়ে গেলেন আত্তিলিও। কিন্তু রাইফেল তুলে ধরার আগেই তার চোখে পড়ল নদীর জলে ভেসে উঠেছে অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি! সেই জীবন্ত ও চলন্ত কাষ্ঠখণ্ডগুলোর স্বরূপ-নির্ণয় করতে আত্তিলিওর ভুল হল না–আহত চফু-মায়ার দিকে ধেয়ে আসছে কুমিরের দল! দীর্ঘকাল ধরে নদী ও জলের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছে যে শয়তান, ছিনিয়ে নিয়েছে জাতভাইদের মুখের গ্রাস বারংবার সে আজ অসহায় বুঝে প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসছে কুমিরের ঝক; চফু-মায়ার মৃত্যুযাতনা তারা উপভোগ করতে চায়, তার দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে তারা আজ বসাতে চায় ভোজের আসর!
দ্রুত, অতি দ্রুতবেগে এগিয়ে আসতে লাগল হিংস্র সরীসৃপের দল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আত্তিলিও তাকিয়ে রইলেন সেই মাংসলোলুপ মিছিলের দিকে। চফু-মায়া তখনও কাবু হয়নি, প্রবল বিক্রমে সে তখনও ছুরি আর দড়ির মারাত্মক বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে হঠাৎ দলের ভিতর থেকে একটা দুঃসাহসী কুমির এগিয়ে এসে কামড়ে ধরল চফু-মায়ার লেজ!
ওই ঝটাপটির মধ্যে লক্ষ স্থির করা খুবই কঠিন, তবু আত্তিলিও রাইফেল তুলে নিশানা করতে সচেষ্ট হলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে লাঙ্গুলের উপর দন্তাঘাতের যাতনা অনুভব করে চফু-মায়া এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে জল থেকে ছিটকে উঠল শূন্যে!
বাওয়ানা!
আত্তিলিওর কানে এল উদবিগ্ন কণ্ঠের আহ্বান। মুহূর্তের জন্য তার পার্শ্বদেশে কী-যেন-একটা বস্তুর আঘাত অনুভব করলেন তিনি। অজ্ঞাতসারে তার মাংসপেশি সংকুচিত হল, আঙুলের চাপ পড়ল রাইফেলের ট্রিগারের উপর সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে অগ্নিউদগার করে হাত থেকে ঠিকরে বেরিয়ে গেল রাইফেল। দোদুল্যমান রঞ্জু এবার তার পাঁজরের উপর থেকে সরে এসে আঘাত করল পায়ের উপর পরক্ষণেই ধনুক-ছাড়া তিরের মতো আত্তিলিওর দেহ এসে পড়ল কুম্ভীরসংকুল নদীগর্ভে!
পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই তিনি ডুবে গেলেন। কয়েক মহূর্তের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন নদীর তলদেশে। চটচটে কাদার মারাত্মক বন্ধন থেকে নিজেকে কোনোরকমে মুক্ত করে আত্তিলিও ভেসে উঠলেন, তারপর তীরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।
জল এখন চিবুক পর্যন্ত। কিন্তু আত্তিলিও আর অগ্রসর হওয়ার সাহস পেলেন না। তার চারদিকে ঘুরছে কুমিরের দল, এখন পর্যন্ত তারা যে আত্তিলিওকে আক্রমণ করেনি এটাই আশ্চর্য। আত্তিলিওর মনে হল দারুণ আতঙ্কে তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। সেটা বরং ভালো, আত্তিলিও ভাবলেন, মৃত্যুর আতঙ্কের চাইতে মৃত্যু অনেক ভালো। এখন ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ততই মঙ্গল…
জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে প্রায় নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়েছিলেন আত্তিলিও, হঠাৎ তার মনে পড়ল নগুরা-গুরার কথা। আফ্রিকার এক আদিম মানুষ যদি ভয়কে জয় করে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে পারে, তবে মহাযুদ্ধের সৈনিক হয়ে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি কি ক্লীবের মতো মৃত্যুর মুখে আত্মসমর্পণ করবেন? কখনোই নয়।
আত্তিলিও আবার অগ্রসর হলেন তীরভূমির দিকে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই একটা পাথরের উপর তার পা পড়ল। জল এখন কাঁধের নীচে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন আত্তিলিও। সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারলেন কেন কুমিরগুলো তাকে আক্রমণ করেনি। চফু-মায়া এখনও লড়াই করছে। দোলা ছুরির নিষ্ঠুর দংশন চফু-মায়ার শক্তিশালী চোয়াল দুটিকে অকেজো করে দিয়েছে বটে, কিন্তু কাটা-বসানো লেজের চাবুক হাঁকড়ে সে আক্রমণকারী শত্রুকুলকে বাধা দিচ্ছে বিপুল বিক্রমে। কুমিরের দল এখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত, তুচ্ছ একটা মানুষকে নিয়ে তারা মাথা ঘামাচ্ছে না–আগে চফু-মায়া, তারপর…।
স্টেডি, বাওয়ানা, মাথার উপর থেকে ভেসে এল কাপালালোর কণ্ঠস্বর, স্টেডি।
সচমকে মুখ তুলে আত্তিলিও দেখলেন তার মাথার উপর একটা গাছের ডালে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে কাপালালো–ডালটাকে নীচু করে আত্তিলিওর নাগালের মধ্যে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে সে প্রাণপণে। তার পিছনে ঘন পাতার আড়ালে বসে রয়েছে আরও দুটি মানুষ। তাদের মধ্যে একজন শক্ত মুঠিতে কাপালালোর দুই পায়ের গোড়ালি ধরে রেখেছে এবং তার পশ্চাত্বর্তীর হাতের মুঠিতে রয়েছে পূর্ববর্তী মানুষটির পা। আত্তিলিওর সঙ্গে সেই জীবন্ত শিকলের প্রথম সংযোগস্থল হচ্ছে কাপালালো। খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তিনটি মানুষের আলিঙ্গনে-আবদ্ধ জীবন্ত শৃঙ্খল, আরও ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগল বৃক্ষশাখা জলের দিকে…
এইবার, কাপালালো বলল, যতটা সম্ভব উঁচু হয়ে গাছের ডালটা ধরো বাওয়ানা। তারপর অপেক্ষা করো।
শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে আত্তিলিও লাফালেন। ডালটা ধরে ফেললেন তিনি। ডাল ধরলেও শরীরটাকে উপরে তোলা সম্ভব হল না, তাঁর অবশ দেহ আবার ঝুলে পড়ল নীচের দিকে। কিন্তু হাতের আঙুলগুলো লোহার সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল ডালটাকে। আত্তিলিওর দেহের ওজন সেই আঙুলের বাঁধনকে শিথিল করতে পারল না।