হঠাৎ রাইফেলের উপর এসে পড়ল একটা হাত।
আত্তিলিও চমকে উঠলেন–হাতের অধিকারী জাদুকর মাতুংগো! জাদুকরের দুই চোখের গভীর দৃষ্টি আত্তিলিওকে তার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিল–তিনি বলেছিলেন কোনো কারণেই মানুষ ও সরীসৃপের দ্বন্দ্বযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবেন না।
মাতুংগোর ঠোঁট নড়ে উঠল, কোনো শব্দ হল না, কিন্তু ওষ্ঠাধরের কম্পন দেখে তার বক্তব্য বুঝতে পারলেন আত্তিলিও–
চফু-মায়া আসছে। তুমি একটুও নড়বে না।
ছাগশিশুর কান্না তখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। চুপ করে অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার জন্য আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট। মনে হচ্ছে কিছুই ঘটবে না। কুয়াশা সরে যাচ্ছে। আত্তিলিও ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলেন–ঘড়ির কাঁটা বলছে এখানে আসার পর কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেছে।
হঠাৎ মাতুংগোর কনুইয়ের চাপ পাঁজরের উপর অনুভব করলেন আত্তিলিও। দুই চোখের দৃষ্টি এদিক-ওদিক চালিত করলেন তিনি, কিছুই নজরে পড়ল না। কোনো অস্বাভাবিক শব্দও তার কানে এল না। নগুরা-গুরা বসে আছে পাথরের মূর্তির মতো, তার পিঠের মাংসপেশিতে এতটুকু কম্পনের সাড়া নেই। একইভাবে কাঁদছে আর কাঁদছে ছাগলের বাচ্চা। আত্তিলিওর চোখে-কানে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ল না।
হঠাৎ আত্তিলিও সাহেবের পাঁজরের উপর থেকে কনুইয়ের চাপ সরে গেল। মাতুংগো কী করে ভয়ংকরের আগমনবার্তা পেয়েছিল বলা যায় না, কিন্তু নদীর জলে একটা হলদে-সবুজ বস্তুর চলমান অস্তিত্ব এইবার আত্তিলিওর চোখে পড়ল। ছাগশিশুর ভয়ার্ত দৃষ্টি এখন নদীর দিকে, আর্তস্বর তীব্র থেকে তীব্রতর!
ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে নদীর জলে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা প্রকাণ্ড মাথা! আত্তিলিওর মনে হল তিনি স্বপ্ন দেখছেন–এমন প্রকাণ্ড কুৎসিত মস্তকের অস্তিত্ব বাস্তবে কল্পনা করা যায় না। জল ছেড়ে উঠে এল ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতা অতিকায় কুম্ভীর চফু-মায়া!
দড়িতে বাঁধা ছাগল-বাচ্চার কয়েক ফিট দূরে এসে থমকে দাঁড়াল কুমির। আত্তিলিও বুঝলেন এইবার সে শিকারকে কামড়ে ধরবে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মাতুংগো। চিৎকারটা বোধ হয় যুদ্ধের সংকেত-মুহূর্তের মধ্যে গাছের আড়াল থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে এল নগুরা-গুরা, ছাগশিশুর মাথার ওপর দিয়ে মেলে দিল প্রসারিত দক্ষিণ হস্ত।
বিদ্যুদ্বেগে এগিয়ে এসে শত্রুকে আক্রমণ করল চফু-মায়া। সশব্দে খুলে গেল দুই ভয়ংকর চোয়াল। একটা তুচ্ছ মানুষের দুর্বল হাত লক্ষ করে এগিয়ে এল চফু-মায়ার দন্ত-কণ্টকিত করাল মুখগহ্বর। পরক্ষণেই আবার ভীষণ শব্দে চোয়াল দুটি বন্ধ হয়ে গেল কুমির বুঝি বজ্রকঠিন দংশনে চেপে ধরেছে শত্রুর হাত!
আত্তিলিও চমকে উঠলেন… না! নগুরা-গুরা সরে এসেছে! তার ডান হাত এখনও অক্ষত অবস্থায় দেহের সঙ্গে সংলগ্ন, কিন্তু যে-অস্ত্রটা একটু আগেও তার ডান হাতের মুঠির মধ্যে ছিল সেই দোলা ছুরিটাকে আর যথাস্থানে দেখা যাচ্ছে না!
চফু-মায়া পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল–পরক্ষণেই এক প্রকাণ্ড ডিগবাজি খেয়ে শূন্য পথে প্রায় পনেরো ফিট উচ্চতা অতিক্রম করে তার বিশাল দেহ এসে পড়ল নদীগর্ভে! ফোয়ারার মতো ছিটকে উঠল জল, চফু-মায়া হল অদৃশ্য!
তারপর নদীর জল তোলপাড় করে জাগল ঢেউয়ের পর ঢেউ! থর থর করে কাঁপতে লাগল গাছে বাঁধা দড়ি! জলের তলায় আত্মগোপন করে চফু-মায়া প্রাণপণে ছুরি আর দড়ির মারাত্মক আলিঙ্গন থেকে মুখগহ্বরকে মুক্ত করতে চাইছে!..
আত্তিলিও বুঝলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধের পালা শেষ; জয়ী হয়েছে নগুরা-গুরা। সঠিক সময়জ্ঞান, ক্ষিপ্রতা এবং সংযত স্নায়ুর সাহায্যে ওই মানুষটি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে।
কিন্তু চরম মুহূর্তে অসীম সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দিলেও বিপদ কেটে যেতেই নগুরা-গুরার অবস্থা হয়েছে নির্জীব জড়পদার্থের মতো। নদীর বুক থেকে ছিটকে এসে জলের ধারা তার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিচ্ছে তবু তার খেয়াল নেই। চোখ পাকিয়ে সে তাকিয়ে আছে আলোড়িত জলরাশির দিকে; মনে হচ্ছে এত বড়ো জীবটাকে সে যে স্বহস্তে মর্মঘাতী আঘাতে পর্যুদস্ত করেছে, ঘটনার এই সত্যতা তার নিজের কাছেই এখন অবিশ্বাস্য!
মাতুংগো তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে একটা হাত রাখল নগুরা-গুরার কাঁধের উপর। আত্তিলিও জানতেন তার অনুচর কাপালালো ওই অঞ্চলের এক সাহসী শিকারি–কিন্তু তিনি দেখলেন ঘটনার ভীষণতা তাকেও স্তম্ভিত করে দিয়েছে! সম্মোহিত মানুষের মতোই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাপালালো!…
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – আত্তিলিওর বিপদ
নদীর বুক থেকে প্রবল বেগে উঠে আসছে উচ্ছ্বসিত জলধারা, সবেগে দুলছে আর দুলছে বৃক্ষে আবদ্ধ লম্ববান রঞ্জু চফু-মায়ার বিশাল দেহ জলের তলায় অদৃশ্য থাকলেও তার মৃত্যুকালীন আক্ষেপ নদীতটে দণ্ডায়মান দর্শকের কাছে অতিশয় স্পষ্ট।
কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও চফু-মায়া ছুরির মারাত্মক দংশন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। দোলা ছুরির ফলা দুটো এমন গভীরভাবে মুখের ভিতর বিধে আটকে আছে যে, বেচারা কুমির না-পারছে মুখ বন্ধ করতে, না-পারছে মুখ খুলতে! সে প্রাণপণে টানাটানি করছে, সঙ্গেসঙ্গে ছুরির মাঝখানে বাঁটে-বাঁধা দড়িতে পড়ছে টান টানাটানির ফলে যন্ত্রণা বাড়ছে; জন্তুটার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘাসে-পাকানো দড়িটা ভীষণ শক্ত। সেটা ছিঁড়ে ফেলা চফু-মায়ার মতো শক্তিশালী জীবের পক্ষেও সম্ভব নয়। ছুরির সঙ্গে আবদ্ধ দড়িটাকে যে গাছের ডালে বাঁধা হয়েছে, সেই ডালটা যদি টানাটানিতে ভেঙে পড়ে তাহলে যন্ত্রণা থেকে রেহাই না-পেলেও কুমির অন্তত সীমাবদ্ধ গণ্ডির বন্ধন দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে কিন্তু তা হওয়ার নয়। আগেই বলেছি ওই জাতের গাছ যেমন নমনীয়, তেমনই কঠিন। গাছটি যে চফু-মায়ার টানাটানি অগ্রাহ্য করে তার অখণ্ডতা বজায় রাখতে সমর্থ সে-কথা জেনেই পূর্বোক্ত বৃক্ষশাখায় দড়ি বেঁধে নরখাদকের মৃত্যুফঁদ সাজিয়েছে জাদুকর মাতুংগো।