দুর্ভেদ্য বর্মের মতো কঠিন চর্মে আবৃত ৩৫ ফিট লম্বা ধূর্ত ও হিংস্র নরভুকের বিরুদ্ধে ছুরিকাসম্বল একটি মানুষের জয়লাভ করার সম্ভাবনা খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল আত্তিলিওর কাছে–এও কি মন্ত্রের প্রভাব? না, মনস্তত্ত্বের মহিমা?…
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দ্বৈরথ
সোম, মঙ্গল, বুধ–
তিনদিন হল নাচগান প্রভৃতি সব অনুষ্ঠান বন্ধ। নদীতট নির্জন। মেয়েরাও নদী থেকে জল আনতে যায় না। জাদুকর মাতুংগোর নির্দেশ–কেউ যেন নদীর ধারে না-আসে; আবার নতুন আদেশ না-পাওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বজায় রাখতে হবে।
বৃহস্পতিবার সকালে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে কাপালালো প্রবেশ করল আত্তিলিওর তাবুতে, তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
কাপালালোর কথামতো তাকে অনুসরণ করলেন আত্তিলিও। কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার। এমনকী ছাগলদেরও দেখা যাচ্ছে না। ফিসফিস করে কাপালালো জানাল যতক্ষণ পর্যন্ত মাতুংগো আদেশ না-দিচ্ছে ততক্ষণ একটি প্রাণীও কুটিরের বাইরে আত্মপ্রকাশ করবে না। মাতুংগো জানিয়েছে বাওয়ানার রাইফেলের শব্দই হচ্ছে গ্রামবাসীদের বেরিয়ে আসার সংকেত। লোকজনের উপস্থিতি বা কথাবার্তার শব্দে জাদুবিদ্যা প্রয়োগের ব্যাঘাত হতে পারে বলেই নাকি এই ব্যবস্থা! সমগ্র এলাকার মধ্যে শুধু একটা ছাগকণ্ঠের ব্যা ব্যা ধ্বনি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ছাগলের গলার আওয়াজটা ভেসে আসছিল কুয়াশায় ঢাকা নদীতট থেকে।
নদীর ধারে পৌঁছে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ছাগশিশুটিকে দেখতে পেলেন আত্তিলিও। নিতান্তই কচি বাচ্চা, কুমিরের প্রিয় খাদ্য।
কথা না-বলে প্রায় তিরিশ ফুট দূরে অবস্থিত আর একটা গাছের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল কাপালালো। গাছটা খুব শক্ত, কিন্তু নমনীয়। ওয়াকাঁপাগারা ওই জাতের গাছ থেকেই তাদের ধনুক তৈরি করে। আত্তিলিও দেখলেন, নির্দিষ্ট গাছটির ডগার দিকে একটা দড়ি বাঁধা আছে। দড়ির পাক খুব আলগা অবস্থায় ঝুলতে ঝুলতে ছাগশিশুর কাছাকাছি গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।
ঘন সন্নিবিষ্ট একটা ঝোঁপের কাছে আত্তিলিওকে টেনে নিয়ে গেল কাপালালো। তারপর তার পাশেই সে গুঁড়ি মেরে বসল। সঙ্গেসঙ্গে একটু দূরে আর একটা ঝোঁপের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল আরও দুটি মনুষ্য-মূর্তি।
একজন হচ্ছে নগুরা-গুরা। তার ডান হাতের পুরোবাহু থেকে কবজি পর্যন্ত জড়িয়ে অবস্থান করছে গাছের ছালের পুরু আবরণ বা ব্যান্ডেজ।
অপর লোকটি মাতুংগো। তার হাতে একটা অদ্ভুত অস্ত্র। সে যখন নীচু হয়ে মাটি থেকে দড়ির ঝুলে-পড়া অংশটা তুলে হাতের অস্ত্রটার মাঝামাঝি জায়গায় জড়িয়ে নিচ্ছে, ঠিক তখনই বস্তুটির স্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেন আত্তিলিও।
জিনিসটা হচ্ছে দোলা ছুরি; দুটো ধারালো ফলার মাঝখানে বসানো আছে শক্ত কাঠের বাঁট। ওই বাঁটের মাঝখানে শক্ত করে দড়িটা বেঁধে মাতুংগো হঠাৎ নগুরা-গুরার কাধ চেপে ধরল। জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে দড়ি বাঁধা দোলা ছুরিটা তুলে নিল নগুরা-গুরার হাতে। একবার তীব্র দৃষ্টিতে নগুরা-গুরার চোখের দিকে তাকাল মাতুংগো–আবার ঝাঁকুনি! খুব জোরে মাথা নাড়ল নগুরা-গুরা, তারপর ঘুরে গিয়ে ছাগশিশুর নিকটবর্তী গাছটার পিছনে বসে পড়ল। আত্তিলিওর মনে হল জাদুকর মাতুংগোর চোখের দৃষ্টি থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি ধাক্কা মেরে নগুরা-গুরার দেহটাকে যথাস্থানে বসিয়ে দিল!
এতক্ষণে সমস্ত পরিকল্পনাটা আত্তিলিওর কাছে পরিষ্কার হল। নগুরা-গুরার সর্বাঙ্গে যে তৈলাক্ত বস্তুটি মাখানো আছে, সেই পদার্থটির গন্ধ মানুষের গায়ের গন্ধ ঢেকে রাখবে–ছাগশিশুর ক্রন্দনে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এলেও চফু-মায়া তার ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে মানুষের উপস্থিতি বুঝে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে না।
তারপর কী ঘটবে সহজেই অনুমান করা যায়। আচম্বিতে একটা মানুষকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখলেই কুমির তেড়ে যাবে, মুহূর্তের জন্য খুলে যাবে দুই চেয়ালের প্রকাণ্ড হাঁ, পরক্ষণেই শত্রুকে মুখগহ্বরে বন্দি করার চেষ্টায় সশব্দে বন্ধ হয়ে যাবে দন্তসজ্জিত দুই চোয়ালের মরণফাঁদ।
সেই হাঁ-করা মুখের সুযোগ নেবে নগুরা-গুরা–পলকের মধ্যে কুমিরের মুখগহ্বরে হাত ঢুকিয়ে এমন কায়দায় সে ছুরিটা ধরবে যে, কুমিরের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে দংশনের চাপে ছুরির দুটো ফলাই সরীসৃপের মুখের ভিতর নরম মাংস ভেদ করে এফেঁড়-ওফেঁড় হয়ে বসে যাবে; কিন্তু দুটো ধারালো ফলা মাঝখানে অবস্থিত শক্ত কাঠের টুকরোটার জন্য কুমির মুখের হাঁ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারবে না এবং সেই একটুখানি ফাঁকের ভিতর থেকেই চট করে হাত টেনে নিয়ে নিরাপদ ব্যবধানে সরে যাবে নগুরা-গুরা।
অসম্ভব, আত্তিলিও ভাবলেন, এ হচ্ছে উন্মাদের চিন্তা। ওইটুকু কাঠের টুকরো কখনোই কুমিরের প্রচণ্ড দুই চোয়ালের চাপ উপেক্ষা করে টিকে থাকতে পারবে না। নগুরা-গুরার ডান হাত ধরা পড়বে কুমিরের মুখের মধ্যে; জন্তুটা যদি তাকে জলের ভিতর না-নিয়ে যায় তাহলেও লোকটার বাঁচার আশা নেই কারণ কামড়ের চাপে তার হাতখানা নিশ্চয়ই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ক্ষতস্থানে গ্যাংগ্রিন-এর যে পচনক্রিয়া শুরু হবে তাতেই লোকটির মৃত্যু অবধারিত।
নগুরা-গুরার অবস্থা বুঝে উদবিগ্ন হয়ে উঠলেন আত্তিলিও। উদ্ভিদের বন্ধন জাল থেকে রাইফেলটাকে তিনি মুক্ত করে নিলেন, তারপর যথাসম্ভব নিঃশব্দে সেফটি-ক্যাচ সরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের সাইট কুড়ি গজের মধ্যে নির্দিষ্ট করতে সচেষ্ট হলেন।