চফু-মায়ার কবলে নিহত যমজ ভগ্নীদের পিতার নাম নগুরা-গুরা। লোকটির দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন–ক্ষীণকায়, শান্তশিষ্ট এই বয়স্ক মানুষটি লড়াই করবে নরভুক অতিকায় কুম্ভীরের সঙ্গে? অসম্ভব, নিশ্চয়ই তিনি কোথাও ভুল করছেন!
তুমি কী বলতে চাও, নগুরা-গুরার দিকে আঙুল দেখিয়ে জাদুকর মাতুংগোকে জিজ্ঞাসা করলেন আত্তিলিও, ওই লোকটি চফু-মায়ার সঙ্গে লড়াই করবে?
হ্যাঁ, বাওয়ানা।
একা? ওর হাতে রাইফেল থাকবে তো?
ও একাই লড়বে। ওর হাতে রাইফেল থাকবে না।
জাদুকরের কুটিরের মধ্যে চুপ করে বসে ছিল নগুরা-গুরা। মাথা নেড়ে সে মাতুংগোর কথায় সায় দিল।
আবার আত্তিলিওর প্রশ্ন, তবে বোধ হয় বিশেষ ধরনের কোনো ফাঁদ নিয়ে ও লড়াই করবে?
না, বাওয়ানা। ফাঁদের সাহায্য ছাড়াই ও লড়বে। ওর হাতে একটা ছুরি আর একটা দড়ি। একমাত্র ওর নিজস্ব ডান হাতটা ছাড়া আর কেউ ওকে সাহায্য করতে আসবে না।
নগুরা-গুরা নামক ছোটোখাটো মানুষটি আবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
জাদুকর মাতুংগো বলল, চফু-মায়া যখন বোঝে বিপদের ভয় বিশেষ নেই তখনই সে দেখা দেয়। আর ওয়াকাঁপাগাদের পক্ষে চফু-মায়ার মোকাবিলা করার ওই একটি সুযোগই আছে। দড়ি আর ছুরি হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র যা দিয়ে চফু-মায়ার সঙ্গে লড়াই করা যায়।
মাতুংগোর কণ্ঠ শান্ত, নিরুবেগ। আত্তিলিও সবিস্ময়ে দেখলেন নগুরা-গুরার ভাবভঙ্গিতেও কিছুমাত্র উত্তেজনার চিহ্ন নেই। অসম্ভব আত্মবিশ্বাস আর সাহসের অধিকারী না হলে কোনো মানুষই নরখাদক কুম্ভীরের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধের নামার আগে এমন নিশ্চিন্তভাবে বসে থাকতে পারে না।
মাতুংগোর গলার স্বর আত্তিলিওর কানে এল, তুমি নিজের চোখেই সব দেখবে।
নগুরা-গুরা সায় দিল, হ্যাঁ, সময় এলেই দেখতে পাবে।
…সময় এল কয়েক সপ্তাহ পরে।
অন্তর্বর্তী দিনগুলো অবশ্য একঘেয়ে লাগেনি আত্তিলিওর কাছে। প্রত্যেক দিন বাদ্য সহযোগে নৃত্যগীত চলত নদীর ধারে। রোদের তাপ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটা ছায়াঘেরা জায়গা বেছে নিতেন আত্তিলিও। তারপর সেখানে বসে উপভোগ করতেন ওয়াকাঁপাগা জাতির নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। ঢালের উপর বর্শাদণ্ডের আঘাতে বাজনা বাজিয়ে গান গাইত যুবকের দল, নাচতে নাচতে নদীর জলে নামত কয়েকটি কুমারী মেয়ে, গায়ের জামা আর মাথার টুপি খুলে ভাসিয়ে দিত জলে পরক্ষণেই নদীর বুক ছেড়ে উধ্বশ্বাসে উঠে আসত সেইখানে, যেখানে বসে আছে নগুরা-গুরা। মুহূর্তের মধ্যে কাছাকাছি দুটি মেয়ের হাত চেপে ধরত নগুরা-গুরা, তারপর চারদিকে দণ্ডায়মান জনতার ব্যুহভেদ করে ছুটত মেয়ে দুটির হাত ধরে। সমবেত জনতাও চিৎকার করতে করতে ছুটত তাদের পিছনে।
কোলাহল থেমে যেত ধীরে ধীরে। পরিশ্রান্ত লোকগুলো কুটিরে প্রবেশ করত আহারাদি সাঙ্গ করে বিশ্রাম নেবার জন্য।
বহুদিন আফ্রিকাতে কাটিয়ে কয়েকটি বিষয়ে আত্তিলিও খুব সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অধিকাংশ মানুষই নিগ্রোদের জাদুবিদ্যার অনুষ্ঠান প্রভৃতিকে বুজরুকি বলে উড়িয়ে দেয় কিন্তু আত্তিলিও জানতেন এই অনুষ্ঠানগুলো মোটেই বুজরুকি নয়, ওইসব ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনস্তত্ত্বের জটিল বিজ্ঞান।
জাদুকররা মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে বিশেষত তার নিজের জাতির মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে, দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল। তারা খুব ভালোভাবেই জানে মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যকে কেমন করে কাজে লাগাতে হয়। উদাহরণস্বরূপ নদীর ধারে নাচগান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যাপারগুলোকে ধরা যাক–
রোজ সকালে তুমুল কোলাহল তুলে একই দৃশ্যের বার বার অভিনয় করার ফলে স্থানীয় মানুষের মনে দুর্ঘটনার স্মৃতি খুব দাগ কেটে দেবে, তারা ভবিষ্যতে অসাবধান হবে না, সুতরাং দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমবে।
নদীর ধারে চিৎকার-চেঁচামেচির ফলে কুমিরের দল হবে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত, সুযোগ পাওয়ামাত্র তারা মানুষকে আক্রমণ করবে। অর্থাৎ নাগুবা-গুরাকে যাতে চফু-মায়া এগিয়ে এসে আক্রমণ করে সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে। প্রতিদিন মেয়েদের গায়ের জামা আর মাথার টুপি ভেসে যাচ্ছে চফু-মায়ার আস্তানার দিকে, ওইসব জিনিসগুলো থেকে ক্রমাগত প্রিয় খাদ্যের গন্ধ পেতে পেতে নরমাংসের লালসায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে ওয়াকাঁপাগাদের নরখাদক দেবতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নগুরা-গুরার দিকে চফু-মায়াকে আকৃষ্ট করার এটাও এক অভিনব কৌশল! রণক্ষেত্র সাজানোর সঙ্গেসঙ্গে চফু-মায়ার প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধাটিকেও প্রস্তুত করা হচ্ছিল ধীরে ধীরে কুটিরের মধ্যে প্রতিদিন সঙ্গোপনে মাতুংগো যে কী মন্ত্র দিত নগুরা-গুরার কানে সে-কথা জানা সম্ভব নয় আত্তিলিওর পক্ষে, কিন্তু ছোটোখাটো মানুষটির মধ্যে মাতুংগোর প্রভাব যে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। নিপুণ কর্মকার যেমন ভোতা লোহাকে শান দিতে দিতে ধারালো অস্ত্রে পরিণত করে, ঠিক তেমনিভাবেই জাদুকর মাতুংগোর হাতে শান খেতে খেতে ঝরে পড়ছিল নগুরা-গুরার আলস্য-অবসাদ আর আতঙ্কের অনুভূতি তুচ্ছ মানবের ক্ষুদ্র দেহের অন্তস্থল ভেদ করে জন্মগ্রহণ করছিল এক প্রতিহিংসাপরায়ণ দৈত্য!
নগুরা-গুরার মুখের দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও বুঝতে পারতেন সে বদলে যাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি, চোয়ালের কাঠিন্য আর দৃঢ় পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায় নগুরা-গুরার ভিতর জেগে উঠেছে অদম্য আত্মবিশ্বাস নরখাদক অতিকায় কুম্ভীরের সঙ্গে দ্বৈরথরণে অবতীর্ণ হতে সে একটুও ভীত নয়! এমনকী আত্তিলিও সাহেবেরও একসময় মনে হল একটা কুমিরকে হাতাহাতি লড়াইতে মেরে ফেলা এমন কী কঠিন কাজ?