দৈর্ঘ্যে পঁয়ত্রিশ ফিট এবং ওজনে চার টন এক মহাশক্তিধর অতিকায় দানবের বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল একটি নগণ্য মানুষ এবং সেই চমকপ্রদ দ্বন্দ্বযুদ্ধের দৃশ্যটিকে স্বচক্ষে দর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন আত্তিলিও গত্তি। যথাসময়ে উক্ত ঘটনার বিবরণ পাঠকের দৃষ্টিগোচর হবে।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ওয়াকাঁপাগাদের গ্রামে আত্তিলিও
ওয়াকাঁপাগাদের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রায় এক সপ্তাহ লাগল। ওয়াকাঁপাগা এক আদিম জাতি, আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে তারা অনিচ্ছুক। তাদের দোষ দেওয়া উচিত নয়। বেলজিয়ানরা কঙ্গোতে উপনিবেশ স্থাপন করার পর ওয়াকাঁপাগাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে এমন কথা বলা যায় না। বেলজিয়ান শাসক ওয়াকাঁপাগাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করার চেষ্টা করেছিল। কোনো লাভ হয়নি। তারা এক পয়সাও রোজগার করে না, ট্যাক্স দেবে কোথা থেকে? তখন তাদের ভিতর থেকে শক্তসমর্থ লোকগুলোকে বেলজিয়ান সরকার ধরে নিয়ে গেল রাস্তা তৈরির কাজের জন্য। অর্থাৎ বেগার খেটে তাদের খাজনা দিতে হবে। এর মধ্যে আবার ওয়াকাঁপাগাদের আস্তানায় হল এক পাদরির আবির্ভাব। খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম প্রচার করার সঙ্গেসঙ্গে পাদরিসাহেব ওয়াকাঁপাগা-জাতির রীতিনীতির নিন্দাও শুরু করলেন। স্থানীয় মানুষ খেপে গেল। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়াত বলা মুশকিল, কিন্তু সমস্ত সমস্যার সহজ সমাধান করে দিল চফু-মায়া–ফাঁকা বুঝে সে একদিন পাদরিসাহেবকে টপ করে খেয়ে ফেলল। ওইসঙ্গে বেলজিয়ান অফিসারটিকেও যদি চফু-মায়া ফলার করে ফেলত তাহলে ওয়াকাঁপাগারা অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যেত।
আত্তিলিওর মন্তব্য শুনে ওয়াকাঁপাগাদের জাদুকর বিরস বদনে ঘাড় নেড়েছিল, লোকটার সঙ্গে অনেকগুলো সৈন্য ছিল যে!
যাই হোক, বেলজিয়ান সরকারের আচার আচরণ ওয়াকাঁপাগারা মোটেই পছন্দ করত না। পূর্বে উল্লিখিত বেলজিয়ান ও ইংরেজ শিকারির মৃত্যুর পর তাদের গ্রামে সরকারি তদন্ত হয়েছিল। শিকারিদের অপঘাত মৃত্যুর জন্য ওয়াকাঁপাগা জাতির উপর মোটা টাকার জরিমানা ধার্য করা হল এবং সেই টাকা পাওয়া গেল না বলে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ শাসক ওয়াকাঁপাগাদের ভিতর থেকে অনেকগুলো জোয়ান মানুষ নিয়ে গেলেন বেগার খাটার জন্য। অর্থাৎ বেগার খেটেই জরিমানার টাকা শোধ দিতে হবে!
এমন সব ঘটনার পর আত্তিলিও সাহেবকে দেখে গ্রামের লোক যদি ভাব জমানোর জন্য এগিয়ে না-আসে তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। আত্তিলিও তাদের দোষ দেননি। তবে ওয়াকাঁপাগাদের মনোভাব দেখে তার মনে হয়েছিল সঙ্গে একদল সৈন্য থাকলে নিরাপত্তা সম্বন্ধে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। অবশ্য সৈন্য না-থাকলেও কাপালালো ছিল। ছোটোখাটো একটা সৈন্যদলের চাইতে কাপালালোর একক উপস্থিতি যে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।
কয়েকটা দিনের মধ্যে ওয়াকাঁপাগাদের সর্দার, জাদুকর প্রভৃতি মাতব্বর শ্রেণির হোমরা চোমরাদের সঙ্গে মেলামেশা করে কাপালালো তাদের বুঝিয়ে দিল আত্তিলিও গত্তি লোকটা খারাপ নয় এবং সরকারের সঙ্গে ওই সাদা মানুষটার কোনো সম্পর্ক নেই। কাপালালো আরও বলল যে, যদি ওয়াকাঁপাগারা তাদের জাদুর খেলা আত্তিলিওকে দেখাতে রাজি হয় তাহলে তিনি তাদের অনেক টাকা দেবেন। ওই টাকা বেলজিয়ান শাসকের হাতে তুলে দিলে আর বেগার খাটার জন্য তাদের লোকগুলোকে সরকার ধরে নিয়ে যাবে না।
বেলজিয়ান কঙ্গোতে প্রবেশ করার আগে আত্তিলিও একটা পঞ্চাশ ডলারের বিল ভাঙিয়ে বেলজিয়ান মুদ্রায় খুচরো করে নিয়েছিলেন। সেই খুচরো টাকার পরিমাণ কম নয়–তিনটি থলে ভরতি টাকা যখন আত্তিলিও তুলে দিলেন ওয়াকাঁপাগা-সর্দারের হাতে, তখন আর তার সদিচ্ছায় কারো সন্দেহ রইল না। ওয়াকাঁপাগা জাতির মধ্যে যে-মানুষটিকে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বলে মনে করা হয় এবং যার কথা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বেদবাক্যের মতোই অভ্রান্ত, সেই মাতুংগো নামক ব্যক্তিটি বলে উঠল, বাওয়ানা আমার বন্ধু। তাকে সব কিছুই দেখানো হবে।
আগামীকাল, মাতুংগোর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো সর্দার, আবার নদীর ধারে কুমারী মেয়েরা নাচবে। ওরা নাচবে চফু-মায়ার জন্য। এবং বাওয়ানার জন্য।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি
আধুনিক সভ্যতা যাদের স্পর্শ করেনি, সেইসব আদিম জাতি খুব সরল ও বিশ্বাসী হয়। ওয়াকাঁপাগা জাতিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। একবার বন্ধুভাবে গ্রহণ করার পর তারা আত্তিলিওর কাছে কিছুই গোপন করার চেষ্টা করল না। কাপালালো যে জাদুর খেলার উল্লেখ করেছিল এইবার সেই জাদু-রহস্য খোলাখুলিভাবে জানতে পারলেন আত্তিলিও।
পর পর দুটি যমজ ভগ্নীকে অবিবাহিত অবস্থায় ভক্ষণ করেছে চফু-মায়া, এখন ওয়াকাঁপাগা জাতির সামাজিক নিয়ম অনুসারে ওই কন্যা দুটির পিতাকে হন্তারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।
কারণটাও বুঝিয়ে বলা হল। যদি যুদ্ধে কন্যাদের পিতা নিহত হয় তাহলে তার আত্মা কুম্ভীরের উদরে আবদ্ধ কন্যা দুটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে আর এক পৃথিবীতে সেখানে শোক-দুঃখ নেই, আছে শুধু আনন্দ। আর যদি কন্যাদের পিতা যুদ্ধে জয়ী হয়, তবে কুমিরের পেট চিরে সে কন্যাদুটিকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করবে এবং মুক্ত আত্মা দুটি সর্বদাই পিতার সঙ্গে থেকে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে সুখে-আনন্দে পরিপূর্ণ করে রাখবে, তাদের চেষ্টায় পিতৃদেবের ধনসম্পদও বৃদ্ধি পাবে।