মাম্বোয়ারা খুব মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। মাম্বায়া সর্দার অভিযাত্রীদের জানাল, তার প্রজাদের মধ্যে চারজনকে তারা বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছেন বলে সে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং সবরকমে তাদের সাহায্য করতে সে প্রস্তুত। বন্দি চারজন স্থানীয় মানুষ, অন্তত শতাধিক গুহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল, তবু যদি প্রয়োজন হয় সর্দার নিজে তাদের সাহায্য করবে–অবশ্য যদি তারা সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করেন।
খুব ভালো কথা। খুব আনন্দের কথা। বিল ও প্রফেসর মাম্বোয়া-সর্দারের কথায় ও ব্যবহারে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কিন্তু আত্তিলিওর মনে খটকা লাগল–হঠাৎ মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের সাহায্য করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠল কেন? এটা অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ নয় তো? আত্তিলিও বন্ধুদের কাছে তার সন্দেহ প্রকাশ করলেন না, মনের কথা মনেই চেপে রাখলেন।
অভিযানের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে চালানোর জন্য অভিযাত্রীরা পরামর্শ করতে বসলেন। পরামর্শের ফলে স্থির হল, প্রত্যেক দিন তিন বন্ধু তিন দিকে যাবেন। বন্দি মাম্বোয়া চারজনের মধ্যে দুজন যাবে প্রফেসরের সঙ্গে, দুজন যাবে বিলের সঙ্গে এবং জামানি নামক জুলু-অনুচরটি থাকবে আত্তিলিওর সঙ্গে। পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি দল হবে তিনটি ভিন্ন পথের পথিক।
অল্প সময়ের মধ্যে একটা বৃহৎ এলাকা পরিদর্শন করার পক্ষে ওই পরিকল্পনা খুবই উপযোগী ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভাবতে গেলে বলতে হয় পরিকল্পনাটা ছিল অতিশয় মারাত্মক। কারণ, গুহার মধ্যে প্রবেশ করে অভিযাত্রীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো হিংস্র জন্তুর সম্মুখীন হন, তবে সম্পূর্ণ এককভাবেই তাকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হবে। নিগ্রোদের মধ্যে কেউ গুহার ভিতর প্রবেশ করতে চাইবে না–তারা অপেক্ষা করবে গুহার বাইরে এবং গুহার ভিতর থেকে আচম্বিতে শ্বাপদকণ্ঠের হিংস্র গর্জন কানে এলে তারা যে পদযুগলের দ্রুত ব্যবহার না-করে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা আছে কি? নিগ্রোরা স্থানীয় মানুষ, খুব সহজেই পথ চিনে তারা তাবুতে ফিরে আসতে পারবে, কিন্তু বিদেশি অভিযাত্রী শ্বাপদের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলেও গুহার বাইরে এসে নিগ্রোদের দেখা না-পেলে আবার বিপদে পড়বেন–ছোটো বড়ো অসংখ্য গ্রানাইট পাথরের দুর্গ, সুড়ঙ্গ আর গোলকধাঁধা ভেদ করে তার পক্ষে সঠিক পথের নিশানা ধরে তাবুতে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব।
এইসব বিপদের সম্ভাবনা তুচ্ছ করেই অভিযাত্রীরা অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিপদ যে হয়নি তা নয়, হয়েছিল। জামানি এবং মাম্বোয়া পথপ্রদর্শকেরা সকলেই গুহার সান্নিধ্য অপছন্দ করত। পথ দেখিয়ে গুহার সামনে নিয়ে যেতে তাদের আপত্তি ছিল না, কিন্তু গুহার প্রবেশপথ থেকে প্রায় ফুট পঞ্চাশ দূরে এসেই তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত, কিছুতেই আর অগ্রসর হতে চাইত না। তাদের দোষ নেই; কয়েকদিনের ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে তাদের ভয় পাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ ছিল।
একটা অজানা গুহার মধ্যে একদিন হঠাৎ বিলের সঙ্গে একটা হায়নার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। বিল গুলি ছুড়ল–গুহার অস্পষ্ট অন্ধকারে তার নিশানা ভালো হয়নি–ফলে জটা মরল না। আহত হল। দ্বিতীয়বার গুলি চালিয়ে হায়নাটাকে হত্যা করার আগে জটা বিলের হাঁটুতে একবার নখের আঁচড় বসিয়েছিল। বিল ক্ষতটার দিকে নজর দেয়নি। হায়না মেরে সে গুহার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল এবং তারপরেও ক্ষতচিহ্নটাকে সামান্য আঘাত বলে তুচ্ছ করেছিল। তাচ্ছিল্যের পরিণাম বিলের পক্ষে ভালো হয়নি। সেইদিনই সন্ধ্যার সময়ে তার ক্ষতটা এমন ভীষণভাবে বিষিয়ে উঠল যে আত্তিলিও ভাবলেন বিলকে বাঁচানোর জন্য ওই পা-টিকে হয়তো কেটে ফেলতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই বিল সেযাত্রা আরোগ্য লাভ করতে সমর্থ হয়।
আর একবার ভারসাম্য হারিয়ে প্রফেসর হঠাৎ পড়ে গেলেন একটা শুকনো গাছের ডালপালার মধ্যে। ডালগুলোতে পাতা ছিল না একটিও। কিন্তু কাটা ছিল প্রচুর পরিমাণে। কাটার আঘাতে প্রফেসরের জামাকাপড় হল ছিন্নভিন্ন, দেহের চামড়ায় হল একাধিক ছিদ্রের সৃষ্টি এবং ওই ছিদ্রপথে কাটার বিষ প্রফেসরের রক্তে ঢুকে তাকে শয্যাশায়ী করে দিল। কাটার মধ্যে কী ধরনের বিষ ছিল ভগবানই জানেন–ঝাড়া দশদিন ধরে প্রফেসর ভুগলেন প্রচণ্ড জ্বরের আক্রমণে।
জ্বরের কবল থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে একটু সুস্থ হয়েই প্রফেসর আবার মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। এবার আর কাটা নয়, দু-দুটো সিংহের সঙ্গে প্রফেসরের দেখা হল একটা অজানা গুহার মধ্যে। প্রফেসর গুলি ছুড়লেন, গুলি লাগল না। সিংহরা আক্রমণের চেষ্টা না-করে বিদ্যুদবেগে গুহার বাইরে অদৃশ্য হলরাইফেলের গর্জিত অগ্নিশিখা তাদের মোটেই পছন্দ হয়নি। প্রায় অন্ধকার গুহার ভিতর দু-দুটো সিংহের মারাত্মক সান্নিধ্য থেকে অক্ষত অবস্থায় পরিত্রাণ পেয়ে খুশি হয়ে প্রফেসর বাইরে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু তার মাম্বোয়া সঙ্গীদের তিনি দেখতে পেলেন না। প্রফেসর বুঝলেন হয় তারা সিংহের কবলে পড়েছে, আর না হয় সিংহদের দেখে গা ঢাকা দিয়েছে। শেষোক্ত সন্দেহই সত্যি, সিংহদের দেখে তারা দৌড়ে পালিয়েছিল। প্রফেসর যদি বুদ্ধিমানের মতো গুহার সামনে অপেক্ষা করতেন তাহলে তিনি অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতেন। কারণ, মাধোয়ারা তাবু থেকে আত্তিলিওকে নিয়ে অকুস্থলে ফিরে এসেছিল। প্রফেসরকে অবশ্য সেখানে পাওয়া যায়নি। মাম্বোয়াদের না দেখতে পেয়ে প্রফেসর নিজেই তাবুতে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলেন এবং দিশাহারা হয়ে গন্তব্যস্থলের বিপরীত দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে মাম্বোয়াদের সাহায্যে আত্তিলিও যখন আড়াই দিন পরে প্রফেসরকে আবিষ্কার করলেন, তখন ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং জ্বরের আক্রমণে ভদ্রলোকের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়।