নিগ্রোরা তাকে নিষেধ করেছিল। শিকারি কারো কথায় কান দিল না। একটা ক্যানো (বিশেষ ধরনের নৌকা) নিয়ে কুমির-শিকারে যাত্রা করল বেলজিয়ান শিকারি। তার সঙ্গে ছিল দুজন স্থানীয় মানুষ। শিকারির কাছ থেকে প্রচুর হাতির মাংস পেয়ে লোক দুটি রাইফেলধারী শ্বেতাঙ্গকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। একদিন খুব ভোরে যাত্রা করল পূর্বোক্ত তিনটি মানুষ এবং জলার ধারে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করতে লাগল মোটবাহকের দল, ওয়াকাঁপাগাদের জনতা এবং কাপালালো স্বয়ং। কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে ভেসে এল রাইফেলের আওয়াজ। তারপরই জাগল মনুষ্যকণ্ঠের অস্ফুট আর্তনাদ। জনতা বুঝল কুমিরের কবলে প্রাণ হারাল তিনটি দুঃসাহসী মানুষ। ক্যানো নৌকাটাও নিখোঁজ হয়ে গেল; সেইসঙ্গে হারিয়ে গেল দাঁড়-বইঠা, নিগ্রোদের দুটি বর্শা, শিকারির রাইফেল।
কাপালালোর গল্প শুনে সমস্ত ব্যাপারটা কী ঘটেছিল সহজেই অনুমান করতে পারলেন আত্তিলিও। জলাভূমির মধ্যে কোনো একটি কুমিরকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল বেলজিয়ান শিকারি, তারপরই আহত জন্তুটার আক্রমণে অথবা অন্য কোনো কুমিরের হামলার মুখে নৌকোটা ভেঙেচুরে ডুবে গিয়েছিল বলেই মনে হয়। কারণ, একবারের বেশি গুলির শব্দ শোনা যায়নি। নৌকো চালিয়ে অকুস্থলে গিয়ে লোকগুলোর সন্ধান নেওয়ার সাহস কারুরই ছিল না। সেধরনের চেষ্টা করেই-বা কী লাভ হত? জলের মধ্যে এক ঝাক মানুষখেকো কুমিরের কবলে পড়লে তিনটি মানুষের পক্ষে কিছুতেই আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়। ওই অঞ্চলের জলাভূমি অসংখ্য নরখাদক কুম্ভীরের বাসস্থান।
কয়েক বছর আগে আরও একটি সাদা মানুষ এখানে এসেছিল,কাপালালো আবার বলতে শুরু করল, সেই লোকটি ছিল ভারি সাহসী, প্রকাণ্ড জোয়ান। আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেই সাদা মানুষ হাতি, সিংহ আর মোষের সামনে গিয়ে ফটো তুলছে। জন্তুগুলোর সামনে যাওয়ার সময়ে সে একটুও ভয় পেত না। তার সঙ্গে রাইফেল থাকত। সে গুলি চালিয়ে শিকারও করত। তার হাতের টিপ ছিল দারুণ ভালো, কোনো সময়েই গুলি ফসকাত না। ওই লোকটিও চফু-মায়ার কথা শুনে তাকে মারতে গিয়েছিল। চফু-মায়া হল দেবতা–তাকে মারা কি সম্ভব? সেই সাদা মানুষটাকে খেয়ে ফেলেছিল চফু-মায়া।
কাপালালোর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে আত্তিলিও বুঝলেন ওই লোকটি ছিল ইংল্যান্ডের মানুষ। ফটো তোলা এবং শিকার ছিল উক্ত ইংরেজের নেশা। আত্তিলিও কাপালালোর মুখ থেকে ওই ইংরেজ-শিকারি সম্পর্কে আরও সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। দিনের বেলা নাকি ঘুমিয়ে কাটাত ইংরেজ, আর রাইফেল ও ক্যামেরা নিয়ে নদীর ধারে অপেক্ষা করত সারারাত জেগে। খুব সম্ভব নদীতটে বিশ্রামরত কুমিরের ফটো তোলার চেষ্টা করেছিল সে। অথবা এমনও হতে পারে কুম্ভীর ও জলহস্তীর দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিরল দৃশ্য আলোকচিত্রে তুলে নেওয়ার জন্য সে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তার সঠিক উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা আর জানা সম্ভব নয়, কারণ এক রাতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ইংরেজ-শিকারি। অকুস্থলে গিয়ে গ্রামবাসীরা ভিজে মাটির ওপর শিকারির দেহের ছাপ এবং রাইফেল দেখতে পায়। ওইখানেই ছিল কুমিরের গুরুভার দেহের সুগভীর পদচিহ্ন। মাটির উপর দিয়ে মনুষ্য-শরীর টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্নও ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। শিকারি যে হঠাৎ নিদ্রার আবেশে অসাবধান হয়ে পড়েছিল এবং সেই সুযোগে জল থেকে উঠে এসে ধূর্ত চফু-মায়া যে শিকারির নিদ্রাকে চিরনিদ্রায় পরিণত করে দিয়েছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কাপালালোর বিবৃতি শুনে আত্তিলিওর বক্তব্য হল নদীগর্ভে অবস্থিত অসংখ্য কুমিরের মধ্যে যেকোনো একটি জীবের পক্ষেই শিকারিকে গ্রাস করা সম্ভব, কিন্তু স্থানীয় নিগ্রোরা ওই লোকটির মৃত্যুর জন্য চফু-মায়াকে দায়ী করছে কোন প্রমাণের জোরে?
উত্তরে কাপালালো জানাল পায়ের ছাপ দেখেই স্থানীয় মানুষ বুঝতে পেরেছিল উক্ত শিকারির হন্তারক হচ্ছে চফু-মায়া স্বয়ং। ওই বিরাট কুমিরটার পদচিহ্নের বৈশিষ্ট্য স্থানীয় নিগ্রোদের সুপরিচিত, পায়ের ছাপ শনাক্ত করতে তাদের ভুল হয়নি একটুও।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল কাপালালো। সংগীত ধ্বনি এবার এগিয়ে আসছে। তাদের দিকে। যেদিক থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছিল সেইদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই আত্তিলিওর দিকে ফিরল কাপালালো, বাওয়ানা, কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাও। এমন ভাব করবে যেন তুমি এখানকার কোনো খবরই রাখো না। দুটি কুমারী মেয়ে মারা পড়েছে, আর দুজনই হচ্ছে যমজ। কাজেই এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। কোনো সাদা মানুষের চোখ যা দেখেনি, সেই আশ্চর্য জাদুর খেলা দেখতে পাবে তুমি। শুধু একটু ধৈর্য চাই।
পথের বাঁকে এইবার আত্মপ্রকাশ করল একটি ছোটোখাটো মানুষ। দুটি মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল ওই লোকটি। তার পিছনে হইহই করতে করতে ছুটছিল শত শত লোকের জনতা। আত্তিলিও এবং তাঁর সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল সবাই। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না।
আমাকে বিশ্বাস করো বাওয়ানা, কাপালালো বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাও।
জায়গাটা ছিল খুব গরম আর কটুগন্ধে পরিপূর্ণ। তবু আত্তিলিও স্থান ত্যাগ করলেন না। সেই রাতেই তিনি স্থির করলেন কয়েকটা দিন কাপালালোর কথামতো চলবেন। ভালোই করেছিলেন বলতে হবে, জায়গা ছেড়ে চলে গেলে এক আশ্চর্য দৃশ্য থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন।