অতএব আত্তিলিও গর্জে উঠলেন, বিয়ে-ফিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাতে চাই না। গাঁয়ের সর্দারকে এখনই ডেকে আনে। লোকজন লাগিয়ে সে এখনই পানীয় জল আর স্নানের উপযুক্ত জলের ব্যবস্থা করুক। তারপর জ্বালানি কাঠ, ফল, ডিম, মুরগি সব চাই ঝটপট! জলদি!
কাপালালো এক পা নড়ল না। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে সে আত্তিলিওর দিকে তাকাল। তার চোখের ভাষা অতিশয় স্পষ্ট–আহা! অবোধ বালক! তুমি জানো না তুমি কী বলছ!
খুব বিশ্বাসী মানুষ কাপালালো। তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আত্তিলিওর অগাধ আস্থা। এর আগে সে কখনো মনিবের আদেশ অমান্য করেনি। এমন বিশ্বাসী প্রভুভক্ত অনুচর যদি হঠাৎ অবাধ্য হয়ে পড়ে তাহলে মনিব আর কী করতে পারেন? নিরুপায় আত্তিলিও আসন গ্রহণ করলেন একটা কাঠের বাক্সের ওপর।
বিরক্ত বা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, বেশ শান্তভাবেই এবার প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও, ব্যাপারটা কী বল তো?
কুমির, কাপালালোর উত্তর, কাল দুই যমজ বোনের মধ্যে ছোটো মেয়েটিকে কুমিরে নিয়েছে।
তাহলে এটা কি শোকসভা? শোক প্রকাশের পর্ব শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমরা কি এইখানেই বসে থাকব?
ওয়াকাঁপাগা জাতির প্রতিবেশী অন্য আর একটি নিগ্রোজাতির মানুষ কাপালালো। প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে অনেক তথ্যই তার জানা আছে। আত্তিলিওর প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল–বিদেশিদের উপস্থিতি এই সময়ে ওয়াকাঁপাগা জাতি পছন্দ করবে না, কারণ এখন তারা চফু-মায়া নামক দেবতাকে পূজা নিবেদন করতে ব্যস্ত।
আত্তিলিও কিছু কিছু স্থানীয় ভাষা জানতেন। চফু-মায়া কথাটার অর্থ তিনি বুঝতে পারলেন–মৃত্যুদূত!
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা আবার কী? প্রেতাত্মা?
না, বাওয়ানা। চফু-মায়া হচ্ছে একটা কুমির। নদীতে আর জলাভূমিতে যেসব কুমির বাস করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আর সবচেয়ে ভয়ানক জন্তুটার নাম চফু-মায়া। গতকাল নাইনি। মেয়েটিকে চফু-মায়া নিয়ে গেছে। ঠিক বছর দুই আগে নাইনির বড়ো বোনকেও ওই জন্তুটা খেয়ে ফেলেছিল। দুটি মেয়েই ছিল যমজ বোন।
আত্তিলিও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ওই হতচ্ছাড়া কুমিরটাকে মারার চেষ্টা না-করে লোকগুলো তাকে পুজো করছে? আশ্চর্য ব্যাপার!
হ্যাঁ, বাওয়ানা, কাপালালো বলল, ওয়াকাঁপাগারা তাকে খুশি করার চেষ্টা করছে। ওরা আশা করছে পুজো পেয়ে যদি চফু-মায়া খুশি হয় তাহলে সে আর ওদের উপর হামলা করতে আসবে না।
আফ্রিকায় আসার পর থেকেই কুমির সম্বন্ধে আত্তিলিও যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা থেকে তিনি বুঝেছেন ওই ভয়ংকর সরীসৃপকে শায়েস্তা করতে পারে শুধু শক্তিশালী রাইফেল। স্থানীয় নিগ্রোদের বর্শা আর তির-ধনুক কুমিরের শক্ত চামড়া ভেদ করে মর্মস্থানে আঘাত হানতে পারে না। কিন্তু জলে নামার জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে ওয়াকাঁপাগা জাতি কুমিরের কবল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে না কেন সেই কথাটাই আত্তিলিও সাহেবের জিজ্ঞাস্য।
অনেকবার সেই চেষ্টা হয়েছে, কাপালালো বলল, কিন্তু এখানে খুব বড়ো গাছ পাওয়া যায় না। হালকা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বেড়া লাগিয়ে দেখা গেছে কোনো লাভ নেই। কুমির লেজের আঘাতে ওইসব বেড়া ভেঙে দেয় অনায়াসে। তা ছাড়া জলে নেমে বেড়া লাগানোর সময়ে বহু মানুষ কুমিরের খপ্পরে প্রাণ হারায়।
আত্তিলিও বললেন, ওরা তাহলে ফাঁদ পাতে না কেন? ফদের সাহায্যে ওই শয়তান জানোয়ারগুলোকে নিশ্চয় কাবু করা সম্ভব?
আত্তিলিওর কথা শুনে চমকে উঠল কাপালালো আর মোটবাহকের দল বাওয়ানা বলে কী!
অজ্ঞান অবোধকে জ্ঞান বিতরণ করার চেষ্টা করল কাপালালো, চফু-মায়া হচ্ছে ওয়াকাঁপাগাদের দেবতা। নিজের দেবতাকে কেউ কখনো ফাঁদ পেতে মারার চেষ্টা করতে পারে?
অকাট্য যুক্তি। সত্যিই তো, দেবতা যতই অত্যাচার করুক, সে দেবতা তো বটে! ঠিক আছে, আত্তিলিও বললেন, কয়েকটা কুমিরকে আমি গুলি চালিয়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেব। এখন চটপট তাঁবু খাঁটিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে ফেলো। ওয়াকাঁপাগাদের সাহায্য তো পাওয়া যাবে না।
একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিল কাপালালো। তারপর সব লোকগুলোকে অন্যান্য কাজে লাগিয়ে দিল। কিন্তু হাজার কাজের মধ্যেও তার দুই চোখের সতর্ক দৃষ্টি ছিল আত্তিলিওর উপর। অতএব আত্তিলিও যখন সংগীতধ্বনি যেদিক থেকে ভেসে আসছে সেইদিকে পদচালনা করার উদ্যোগ করলেন, তৎক্ষণাৎ তার সামনে ছুটে এল কাপালালো-না, বাওয়ানা, ওদিকে যেয়ো না! কাপালালোর কণ্ঠস্বরে উদবেগের আভাস। কোথাও যাব না?
ওখানে? আত্তিলিও নদীর দিকে হাত দেখালেন।
না, কুমিরদের উপর গুলি চালাতে যেয়ো না, দারুণ উদবেগে কাপালালোর কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল, ওখানে গেলে আর একটা সাদা মানুষের যেভাবে মৃত্যু হয়েছে, তোমারও সেইভাবে মৃত্যু হবে।
কী আজেবাজে বকছ?আত্তিলিও ধমকে উঠলেন, এই অঞ্চলে কোনো সাদা মানুষ আসে না।
নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে কাপালালো একটি ঘটনার উল্লেখ করল। ঘটনাটা ঘটেছিল অনেকদিন আগে। কাপালালো তখন বালক মাত্র। সেই সময় জনৈক বেলজিয়ান শিকারির কাছে মোটবাহকের কাজ করেছিল কাপালালো। ওয়াকাঁপাগাদের আস্তানার কাছে এসে উক্ত শিকারি যখন শুনল বহু স্থানীয় মানুষ কুমিরের কবলে প্রাণ হারিয়েছে, তখনই সে জলাভূমিতে গিয়ে রাইফেল চালিয়ে নরখাদক সরীসৃপদের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলার সংকল্প করল।