গাগি! উক্ত গরিলার মেজাজ খুব ভালো নয় বলেই শুনেছিলেন আত্তিলিও, অন্তত সেই মুহূর্তে তার খারাপ মেজাজ যে আরও খারাপ হয়েছে সে-বিষয়ে আত্তিলিওর একটুও সন্দেহ ছিল না।
আরও একটি বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলেন। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল পিগমিরা ধারেকাছেই আছে। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ নেই, সম্পূর্ণ একক অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আর তাকে লক্ষ করে ধেয়ে আসছে তিন-তিনটি মারমুখো গরিলা!
আত্তিলিও দেরি করলেন না, রাইফেল তুললেন। সবার আগে ধেয়ে আসছে গরিলারাজ মোয়ামি গ্লাগি, তার জ্বলন্ত কয়লার মতো দুই প্রদীপ্ত চক্ষু আর হাঁ করা মুখের দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি।
জন্তুটার বুক লক্ষ করে তিনি গুলি ছুড়লেন। গরিলা মাটিতে পড়ল না! সে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল! তার গতিবেগ হয়ে উঠল দ্রুত থেকে দ্রুততর–ঝড়ের বেগে সে এগিয়ে
আসতে লাগল আত্তিলিওর দিকে।
আত্তিলিও হতভম্ব! এত কাছ থেকে তিনি কি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন? গরিলা তখন তার কাছ থেকে প্রায় বিশ ফিট দূরে আছে। রাইফেলে গুলি ছিল না, চটপট গুলি ভরে আত্তিলিও আবার রাইফেলের ঘোড়া টিপলেন।
দ্বিতীয় বারের উদ্যম ব্যর্থ হল না। গরিলা থেমে গেল, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। জন্তুটা এত কাছে এসে পড়েছিল যে, তার দেহের ধাক্কায় একটা গাছের ডাল ভেঙে ছিটকে এসে লাগল আত্তিলিওর হাঁটুতে।
গরিলারাজ মোয়ামি ন্গাগি সেখানেই মৃত্যুবরণ করল। কিন্তু তখনও আত্তিলিওর বিপদ কাটেনি। দানবের দুই সহচারী ধেয়ে আসছে তাকে লক্ষ করে। রাইফেল তুললেন আত্তিলিও, আর সঙ্গেসঙ্গে তার মনে পড়ল কমিশনার সাহেবের সাবধানবাণী–
জেল! জরিমানা! বহিষ্করণ!
ওরে বাবা! গরিলার চাইতে কমিশনারের আইন কিছু কম বিপজ্জনক নয়! আত্তিলিও শূন্যে রাইফেল তুলে তিনবার আওয়াজ করলেন। বরাত ভালো, তাতেই কাজ হল। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে মেয়ে-গরিলা দুটো পালিয়ে গেল বনের মধ্যে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্তিলিও মাটিতে বসে পড়লেন। তার আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ছিল না। একটু দূরেই ধরাশায়ী গরিলারাজের প্রকাণ্ড মৃতদেহটা তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। আর হঠাৎ যেন জাদুমন্ত্রের গুণে জনশূন্য অরণ্য দলে দলে মানবসন্তান প্রসব করতে শুরু করল! একটু আগেই যেখানে জনমানুষের চিহ্ন ছিল না, সেখানেই কোথা থেকে কে জানে এসে দাঁড়াল একদল বেঁটে বেঁটে মানুষ। মামুটি পিগমি!
সুলতানি কাসিউলা বীর বিক্রমে এগিয়ে এসে মৃত গরিলার মস্ত বড়ো উদরের উপর পা তুলে দিল, তারপর পেটের উপর একটা শুষ্ক ক্ষতচিহ্নের দিকে আত্তিলিওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাল কয়েক বছর আগে ওই জায়গাতেই পিগমিদের বর্শা বিঁধেছিল।
যাক এতদিনে প্রতিশোধ নেওয়া হল, সগর্বে বলে উঠল কাসিউলা, মোয়ামি ন্গাগি মারা গেছে।
আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ তখন রাগে জ্বলছে। কাসিউলা যে কিটাম্বোর নাম করে মোয়ামি ন্গাগির ডেরার দিকে তাকে চালিত করেছিল সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই–পিগমিদের বর্শা, আর তিরধনুক ওই দানবের বিরুদ্ধে অচল বলে স্বয়ং আত্তিলিওকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে কাসিউলা!
খুব রেগে গেলেন আত্তিলিও, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। কাসিউলার ভুলটা যে নিতান্তই ইচ্ছাকৃত সে-কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
মাঘ-ফাল্গুন ১৩৭৯
৫. নরখাদক দেবতা
সৈনিকের পঞ্চম অভিজ্ঞতা
নরখাদক দেবতা
প্রথম পরিচ্ছেদ – কাপালালোর পরামর্শ
আত্তিলিও গত্তি তাঁর পূর্বতন অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন যেকোনো নূতন স্থানে পদার্পণ করার সঙ্গেসঙ্গেই স্থানীয় মানুষ তাকে অভ্যর্থনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ওয়াকাঁপাগা নামক নিগ্রোদের গ্রামে পৌঁছে তিনি একটি মানুষকেও দেখতে পেলেন না। তবে হ্যাঁ, কয়েকটা ছাগল গ্রামের ভিতর থেকে ব্যা-ব্যা শব্দে আগন্তুকদের সম্বন্ধে তাদের মতামত জানিয়েছিল বটে!
ব্যাপারটা কী? আত্তিলিও মোটবাহকদের সর্দার কাপালালোকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকগুলো কি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল?
কাপালালো মনিবের সম্মতির জন্য অপেক্ষা না-করে মোটবাহকদের মালপত্র সেখানেই নামিয়ে রাখতে আদেশ করল, তারপর পুবদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, শোনো।
আত্তিলিও কান পেতে শুনলেন নির্দিষ্ট দিক থেকে ভেসে আসছে সংগীত ও বাদ্যের সুমধুর ধ্বনি। তাঁর মনে হল দূরবর্তী নদীতটই পূর্বোক্ত গীতবাদ্যের উৎসস্থল। সম্ভবত ওইখানেই সমবেত হয়েছে গ্রামের সমস্ত মানুষ।
বিয়ের ব্যাপার নাকি? আবার প্রশ্ন করলেন আত্তিলিও।
উত্তর এল না। কাপালালো হঠাৎ বোবা হয়ে গেছে। আত্তিলিও-বিরক্ত হলেন। চারদিন ধরে কুম্ভীর-সংকুল জলপথে নৌকা চালিয়ে এবং আগুন-ঝরা রোদের ভিতর বারো ঘণ্টা পা চালিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পথের মধ্যে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য কীটপতঙ্গ, তাদের কামড়ের জ্বালায় তাঁর সর্বঅঙ্গ জ্বলছে–বলাই বাহুল্য শরীরের এমন অবস্থায় বিয়ের উৎসব দেখার ইচ্ছে তার ছিল না।
এখন তিনি তাঁবু খাঁটিয়ে ভিতরে ঢুকে বিশ্রাম নিতে চাইছেন। বিশ্রামের আগে পরিষ্কার জল আর সাবান সহযোগে সমস্ত শরীর ধুয়ে পতঙ্গের দংশনে ক্ষতবিক্ষত স্থানগুলোতে আইওডিন লাগানো দরকার এখন কি উৎসব-টুৎসব ভালো লাগে?