সেদিনও পূর্বোক্ত কৌশল প্রয়োগ করল পলাতক বামনের দল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ভীষণ গর্জন করে থমকে দাঁড়াল গরিলারাজ–তার বিপুল উদরদেশে গভীরভাবে বিদ্ধ হয়েছে একটি বর্শা!
পিগমিরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে আহত জন্তুটাকে লক্ষ করতে লাগল। গরিলা বর্শাটাকে পেট থেকে বাইরে আনার জন্য প্রাণপণে টানাটানি শুরু করল। সেজন্য জন্তুটার খুবই কষ্ট হচ্ছিল সন্দেহ নেই, কারণ বর্শাফলকের দুই প্রান্ত বাঁকা হুক-এর মতো তৈরি করে পিগমিরা একবার শরীরের ভিতর ঢুকলে ওই বাঁকানো ফলা দুটো আর সহজে বাইরে আসতে চায় না।
কয়েকবার টানাটানি করেও যখন গরিলা বর্শাটাকে পেট থেকে বাইরে আনতে পারল না, তখন সে ঝোঁপঝাড় ভেঙে বনের ভিতর অদৃশ্য হল। পিগমিরা ভাবল জন্তুটা জঙ্গলের মধ্যে কোথাও মরে থাকবে। কয়েক মাস পরে আহত গরিলা আবার পিগমিদের এলাকাতে দর্শন দিল। এবার সে একা নয়, এক সুবৃহৎ গরিলা-পরিবারের দলপতি হয়ে ফিরে এসেছিল মোয়ামি গাগি তার দেহ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বভাব আগের চেয়েও উগ্র, আগের চেয়েও ভয়ংকর!
কাসিউলার গল্প শুনে খুব মজা পেয়েছিলেন আত্তিলিও। পিগমিদের হাত পা নেড়ে বলার ভঙ্গিটা সত্যি উপভোগ্য। গল্প হিসাবে তাদের বক্তব্য ভালোভাবেই উপভোগ করেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু কথাগুলো তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। পরে অবশ্য তিনি জানতে পেরেছিলেন কাসিউলার কথা নিতান্ত রটনা নয়, প্রকৃত ঘটনা। তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দিয়েছিল পিগমি সর্দার কাসিউলা এবং সেই প্রমাণের ধাক্কায় আত্তিলিও সাহেবের প্রাণপাখি দেহের খাঁচা ছাড়ার উপক্রম করছিল!
ঘটনাটা এবার বলছি।
একদিন দুপুর বেলা আত্তিলিও যখন কিটাম্বোর দলের পিছু নিয়েছেন, সেই সময় হঠাৎ কাসিউলা থমকে দাঁড়াল। সে উগ্রীব হয়ে কিছু শুনল, বাতাসে কয়েকবার ঘ্রাণ গ্রহণ করল, তারপর পার্শ্ববর্তী ঝোঁপঝাড় পরীক্ষা করতে লাগল।
ব্যাপারটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। অধিকাংশ সময়েই ওইভাবে গরিলাদের গন্তব্যপথ নির্ণয় করে থাকে কাসিউলা, কাজেই আত্তিলিওর মনে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়নি। কিন্তু সে যখন ফিসফিস করে বলল, ওই যে, ওদিকে গেছে ন্গাগি, এবং সামনের পর্বতচূড়ার দিকে অগ্রবর্তী অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আত্তিলিওকে এগিয়ে যেতে বলল, তখনই তার সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। আত্তিলিও সাহেব দারুণ উত্তেজনায় অসতর্ক হয়ে পড়েছিলেন, তার উপর দুর্গম অরণ্যে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করার ফলে তিনি এত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, কাসিউলার আচরণের অসংগতি তার নজর এড়িয়ে গেল। তিনি যদি সতর্ক থাকতেন তবে নিশ্চয়ই জানতে চাইতেন অন্যান্যবারের মতো সামনে এগিয়ে পথপ্রদর্শক হওয়ার পরিবর্তে হঠাৎ কাসিউলা এখন নিজে পিছনে থেকে তাকে এগিয়ে যেতে বলছে কেন? আত্তিলিওর বরাত খারাপ, কাসিউলাকে কোনো প্রশ্ন না-করে তিনি বোকার মতো পায়ের ছাপগুলোকে অনুসরণ করলেন।
পাহাড়ের গা ছিল ভীষণ খাড়া। হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন আত্তিলিও।মসার রাইফেলটা যাতে লতা আর উদ্ভিদের জালে জড়িয়ে না যায় সেদিকেও তাকে লক্ষ রাখতে হয়েছিল, তাই আশেপাশে দৃষ্টি দেবার অবসর তার হয়নি। আত্তিলিও বরাবরই লক্ষ করেছেন জঙ্গলের পথে পিগমিরা ছায়ার মতো নিঃশব্দে তার সঙ্গে এগিয়ে যায়। তাই তাদের সাড়া শব্দ না-পেলেও বামনরা যে তার পিছন পিছন আসছে সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন নিঃসন্দেহ। ঝোঁপঝাড় আর লতাপাতার ব্যুহ ভেদ করে খাড়াই বেয়ে উঠছিলেন আত্তিলিও, মনে মনে ভাবছিলেন এই সময় যদি পাহাড়ের উপর থেকে কোনো গরিলা হঠাৎ তাদের উপর লাফিয়ে পড়ে তাহলে তিনি তো রাইফেল ব্যবহার করার সুযোগই পাবেন না–তলা থেকে বর্শা চালিয়ে পিগমিদের পক্ষেও ওইরকম আক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। গরিলা যদি ওইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে তার প্রকাণ্ড দেহের ভারে পিষ্ট হয়ে সকলের মৃত্যু হবে, জন্তুটাকে আর কষ্ট করে হাত পা চালাতে হবে না–
অতএব চটপট পাহাড়ের উপর সমতল ভূমিতে পা রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আত্তিলিও।
হাঁপাতে হাঁপাতে আর দুড়দাড় শব্দে ঝোঁপঝাড় ভাঙতে ভাঙতে আত্তিলিও পাহাড়ের উপর একটা ডিম্বাকৃতি সমতলভূমির উপর এসে পৌঁছালেন। ওইরকম শব্দ করে গরিলার পিছু নেওয়া নির্বোধের কাজ, কিন্তু আত্তিলিও ঘন জঙ্গলের মধ্যে পিগমিদের মতো নিঃশব্দে দ্রুত চলাফেরা করতে পারতেন না। উপরে পৌঁছে ঝোঁপঝাড়, ঘাসপাতা আর বৃক্ষশাখার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে আর রাইফেলটাকে মুক্ত করলেন আত্তিলিও, তারপর যে লায়ানা লতাটা এর মধ্যে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল সেটাকে টানাটানি করে সরিয়ে দিলেন তিনি। যাই হোক, এতক্ষণ বাদে একটা সমতল স্থানে পা রাখতে পেরে আত্তিলিও একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মৃদুস্বরে কাসিউলাকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি–আচম্বিত তার কানের পর্দা ফাটিয়ে জেগে উঠেছে তিন-তিনটি কণ্ঠের বীভৎস চিৎকার।
পরক্ষণেই সামনের ফাঁকা জায়গার বিপরীত দিকে অবস্থিত জঙ্গল ভেদ করে আবির্ভূত হল তিনটি বিপুলাকৃতি গরিলা!
এতক্ষণ পরে আত্তিলিওর বুদ্ধি খুলল–
কাসিউলা পরিচয় করিয়ে না-দিলেও মুহূর্তের মধ্যেই তিনি বুঝে ফেললেন আক্রমণকারী গরিলাদের সামনে এগিয়ে এসে যে দানবটা দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে কিটাম্বো নয়–স্বয়ং মোয়ামি