ধাবমান গরিলাদের নাগাল পেতে হলে আবার কয়েক ঘণ্টা ঊর্ধ্বশ্বাসে তাদের পিছু পিছু ছোটা দরকার। সেইখানেই আত্তিলিওর প্রবল আপত্তি, ঘন জঙ্গলের মধ্যে অনর্থক ছোটাছুটি করে কষ্ট পেতে তিনি মোটেই রাজি ছিলেন না। অতএব গরিলারা কিছুদূর এগিয়ে গেলে পিগমি-সর্দার কাসিউলার নির্দেশ অনুসারে তাদের পিছু নিয়ে এগিয়ে যেতেন আত্তিলিও এবং ওইভাবে চলাফেরা করার ফলে অনুসরণকারী মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হতে পারেনি গরিলার দল। একটা জায়গা ছেড়ে আর একটা জায়গার উদ্দেশে গরিলাদের পদচালনা করতে দেখলেই আত্তিলিও বসে পড়তেন একটা গাছের গুঁড়ির উপর। তারপর বেশ খানিকটা সময় কেটে গেলে তিনি আবার তাদের পিছু নিতেন। ওই সময়টা চুপচাপ বসে–থেকে আত্তিলিও পিগমিদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চেষ্টা করতেন।
আগেই বলেছি ওই অঞ্চলের গরিলাদের প্রত্যেকটি পশুরই নামকরণ করেছিল পিগমিরা। কিটাম্বো নামে একটা মস্ত পুরুষ-গরিলাকে পিগমিরা ভীষণ ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কের সঙ্গে একটা শ্রদ্ধার ভাবও দেখেছিলেন আত্তিলিও। একদিন কাসিউলাকে ডেকে আত্তিলিও জিজ্ঞাসা করলেন এমন ভয়ানক জন্তুটাকে তারা হত্যা করেনি কেন? উত্তরে কাসিউলা জানাল শ্বেতাঙ্গদের আইনে গরিলা মারলে শাস্তি পেতে হয় বলেই তারা উক্ত কিটাম্বোর অস্তিত্ব সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। আত্তিলিও বুঝলেন কাসিউলা মিথ্যা কথা বলছে। গরিলার মাংস যে পিগমিদের প্রিয় খাদ্য এবং শ্বেতাঙ্গ শাসকের আইন অমান্য করে তারা যে সুযোগ পেলেই গরিলা শিকার করে সেই তথ্য আত্তিলিওর অজ্ঞাত ছিল না। সাদা মানুষের আইনের কথা নিতান্তই বাজে কথা, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মহাশক্তিধর কিটাম্বোর হিংস্র আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার সাহস ছিল না বলেই পিগমিরা তাকে কখনো হত্যার চেষ্টা করেনি।
স্বয়ং কমিশনার সাহেব আত্তিলিওকে জানিয়েছিলেন পিগমিদের গরিলা শিকার থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও বেলজিয়ামের শ্বেতাঙ্গ-সরকার সুবিধা করতে পারেননি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে সুবিধা পেলেই পিগমিরা গরিলা মেরেছে। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যের ভিতর ঢুকে দোষীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। কিন্তু সরকারের আইনের সাহায্য ছাড়াই গরিলারা যে খর্বকায় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে তার কারণ হচ্ছে তাদের নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য। মাঝে মাঝে গরিলা শিকার করলেও কয়েকটা অতি-বৃহৎ অতিহিংস্র গরিলার সামনে যেতে ভয় পেত পিগমিরা, তাদের বর্শা আর তিরধনুক নিয়ে ওইসব অরণ্যচারী দানবের মোকাবেলা করা অসম্ভব। কিটাম্বোর মতোই ভয়ানক আর একটি পুরুষ-গরিলা পিগমিদের এলাকার মধ্যে বাস করত। কিটাম্বোকে নিয়ে পিগমিরা বিশেষ মাথা ঘামাত না, কিন্তু মোয়ামি ন্গাগি নামক অপর গরিলাটি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যথেষ্ট। মোয়ামি ন্গাগিকে পারলে নিশ্চয়ই হত্যা করত কাসিউলা, সেই চেষ্টাও যে হয়নি তা নয়–তবে পূর্বতন অভিজ্ঞতার ফলে কাসিউলা জেনেছিল ওই ভয়ংকর দানবের সামনে গেলে পিগমিদের মৃত্যু অবধারিত, তাই অনর্থক দলের লোকের প্রাণ বিপন্ন না-করে অন্য উপায়ে তাকে বধ করতে চেয়েছিল পিগমি-সর্দার সুলতানি কাসিউলা।
মোয়ামি ন্গাগি নামের ভয়ংকর গরিলাটি সম্পর্কে সব কথা খুলে বলেছিল কাসিউলা আত্তিলিওর কাছে। নিজেদের জীবন বিপন্ন না-করে জন্তুটাকে হত্যা করার অন্য উপায় থাকলে সে তাই করবে এ-কথাও বলেছিল কাসিউলা–কিন্তু সেই অন্য উপায় যে কী হতে পারে সে-বিষয়ে সে কোনো আলোচনা করেনি এবং আত্তিলিও সাহেবও ওই ব্যাপারে পিগমি-সর্দারের নীরবতা নিয়ে মাথা ঘামাননি। মাথা ঘামালে ভালো করতেন, অন্তত কয়েকটা ভয়ংকর মুহূর্তের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। পরে যখন কাসিউলার পরিকল্পনা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তখন আর বিপদকে এড়িয়ে যাওয়ার সময় ছিল না তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত! অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাইফেল হাতে সেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়েছিলেন আত্তিলিও নিতান্তই আত্মরক্ষার জন্য।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – গরিলারাজ মোয়ামি ন্গাগি
পিগমিদের ভাষায় মোয়ামি ন্গাগি কথাটার অর্থ হচ্ছে গরিলার রাজা। পিগমিদের এলাকার গরিলাদের মধ্যে পূর্বোক্ত গরিলাটি ছিল সবচেয়ে বড়ে, সবচেয়ে ভয়ংকর। গরিলারা খুব শান্তশিষ্ট নয়, কিন্তু গরিলারাজ মোয়ামি ন্গাগির মতো হিংস্র ও উগ্র চরিত্র গরিলাদের মধ্যেও দেখা যায় না।
পিগমি-দলপতি কাসিউলা ওই গরিলাটিকে ঘৃণা করত। ঘৃণাটা অহেতুক নয়। কয়েক বছর আগে কাসিউলার দলভুক্ত ছয়টি পিগমি-শিকারির সঙ্গে তার ছেলেরাও গিয়েছিল খাবারের জন্য সাদা পিঁপড়ে ধরতে। হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে গরিলারাজ মোয়ামি গ্লাগি পিগমিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাসিউলার এক ছেলে এবং তার এক সঙ্গী গরিলার ভয়ংকর আলিঙ্গনে ধরা পড়ল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের সর্বাঙ্গ হয়ে গেল চূর্ণবিচূর্ণ। দলের অন্য সবাই পালাল। দুটি মানুষকে হত্যা করেও দানব ক্ষান্ত হতে চাইল না, মৃতদেহ দুটি মাটিতে ফেলে সে পলাতক পিগমিদের তাড়া করল।
আত্মরক্ষার জন্য পিগমিরা এইবার তাদের প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করল। গরিলা তেড়ে এলে পিগমিরা পালাতে পালাতে বর্শাদণ্ড উলটো করে মাটিতে বসিয়ে দেয়–বর্শাদণ্ড এমনভাবে মাটিতে গেঁথে যায় যে, ধারালো ফলার মুখটা ঘোরানো থাকে অনুসরণকারী গরিলার দিকে এবং ওইভাবে বর্শাদণ্ড মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার সময়ে পলাতকরা এক মুহূর্তের জন্যও থামে না, তাদের গতিবেগ থাকে অব্যাহত। ফলে যে-পথ দিয়ে পিগমিরা পালাতে থাকে সেই পথের জায়গায় জায়গায় ঘন পত্রপল্লবের অন্তরাল থেকে মাটির উপর কোনাকুনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকগুলো বর্শার উদ্যত ফলা গরিলাকে অভ্যর্থনা করার জন্য! ক্ষিপ্ত গরিলা নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করে না, দারুণ ক্রোধে সাময়িকভাবে সাবধান হওয়ার কথাও সে ভুলে যায় তার ফলে পিগমিদের পিছু নিয়ে ছুটতে ছুটতে সে এসে পড়ে বল্লমে কণ্টকিত পথের উপর, আর অনিবার্যভাবেই দানবের ধাবমান বিপুল দেহের গতিবেগে একটা-না-একটা বর্শা সবেগে ঢুকে যায় তার বুকে কিংবা পেটে!