ভোর হলেই আবার গরিলারা বেরিয়ে পড়ে আহারের সন্ধানে। আত্তিলিও তাঁর পিগমি-বাহিনী নিয়ে গরিলাদের পরিত্যক্ত আস্তানা থেকে পদচিহ্ন ধরে জন্তুগুলোকে অনুসরণ করতেন। এই ব্যাপারে কাসিউলার দক্ষতা অসাধারণ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্তিলিও সাহেব গরিলাদের পথ-চলার চিহ্ন আবিষ্কার করতে না-পারলেও কাসিউলা নির্ভুলভাবে জন্তুগুলোর গন্তব্য পথ নির্ণয় করতে পারত। কী করে পারত সেটা অবশ্য আত্তিলিও বুঝতে পারেননি। কয়েক জায়গায় গরিলাদের পায়ের ছাপ তুলেছিলেন আত্তিলিও প্লাস্টার অব প্যারিস নামক পদার্থের সাহায্যে। সবচেয়ে বড় পায়ের ছাপ ছিল ১৪ ইঞ্চি লম্বা, ৬ ইঞ্চি চওড়া এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে কনিষ্ঠ অঙ্গুলি পর্যন্ত পদচিহ্নের বিস্তার ৭ ইঞ্চি। জন্তুটার দেহের ওজন সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা দেবার জন্য আত্তিলিও বলেছেন পিগমিদের পায়ের ছাপ যতই গম্ভীর হয়, তার চারগুণ গম্ভীর হয়ে মাটির উপর পড়ে গরিলার পদচিহ্ন।
ওই পায়ের চিহ্ন দেখে গরিলাদের চিনতে পারত কাসিউলা। পিগমিরা তাদের এলাকার প্রত্যেকটি গরিলার নামকরণ করেছিল। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু শুধু পায়ের ছাপ দেখেই কাসিউলা বলে দিত কোন কোন জন্তুর পদচিহ্ন! এ-বিষয়ে তার একবারও ভুল হয়নি।
খুব ধীরে ধীরে পা চালিয়ে গরিলাদের অনুসরণ করতেন আত্তিলিও। অতিকায় বানরগুলোর গতিবিধি তিনি লক্ষ করতেন জঙ্গলের আড়াল থেকে অথবা গাছের উপর থেকে।
গরিলারা প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উদরস্থ করে। কারণ, তাদের দেহের পরিধি যেমন বিরাট, তাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত জিনিসগুলোর আকার তেমনই অতিশয় ক্ষুদ্র। মিয়ান্দো নামক এক ধরনের শাক তাদের প্রিয় খাদ্য। মিয়ান্দো ভক্ষণে ব্যস্ত একদল গরিলাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আত্তিলিও সাহেবের। একটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে অবস্থান করেছিল মিয়ান্দো শাকের খেত, কয়েক মিনিটের মধ্যেই গরিলারা জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলল! খেতের সমস্ত শাক উদরস্থ করেই দলটা আবার খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যাত্রা করল দলপতির নির্দেশে।
আহার্য বস্তু সংগ্রহ করার জন্যই গরিলারা সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে বাধ্য হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটা বিস্তীর্ণ এলাকার ফলমূল, শাকসবজি তারা উদরস্থ করে ফেলে, অতএব খুব বেশি ঘোরাঘুরি না-করলে তাদের রাক্ষুসে খিদে মিটবে কেন? গরিলাদের প্রিয় খাদ্য হচ্ছে মিয়ান্দো শাক, বুনো কলা, বুনো পেঁয়াজ আর কচি বাঁশের গোড়া। ভোরবেলা থেকে শুরু করে বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত চলে তাদের ভ্রমণ আর আহার পর্ব–তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের খাদ্যসংগ্রহের বিরাম নেই। খুব সম্ভব সেইজন্যই তারা প্রতিরাত্রে নূতন নূতন রাতের আস্তানা তৈরি করতে বাধ্য হয়। আহারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তারা বিকালের দিকে আগের আস্তানা থেকে এত দূরে এসে পড়ে যে, সেখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না–অতএব রাত্রিবাসের জন্য নূতন ঘর না-বেঁধে আর উপায় কী?
দুপুর বেলা গরিলারা যখন বিশ্রাম করে সেইসময় কয়েকদিন তাদের লক্ষ করেছিলেন আত্তিলিও। কয়েকটি পূর্ণবয়স্ক গরিলাকে সটান ঘাসের উপর লম্বা হয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে দেখা গেল, কয়েকটা জন্তু আবার গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে ঘুম লাগাচ্ছে। একদিন একটা গরিলা-বাচ্চার কাণ্ড দেখে খুব মজা পেয়েছিলেন আত্তিলিও। একটা কিশোরবয়স্ক গরিলার সঙ্গে বাচ্চাটা খেলা করছিল। গাছের উপর-নীচে ছুটোছুটি করে তারা পরস্পরকে তাড়া করছিল খেলার ছলে, কখনো-বা লায়ানা লতা ধরে ঝুলছিল প্রবল উৎসাহে, আবার কখনো-বা লুকোচুরি খেলার আনন্দে তারা মশগুল। হঠাৎ বাচ্চাটা খেলা ছেড়ে তার মায়ের কাছে এসে পড়ল। মা বসে বসে ঢুলছিল, বাচ্চার বোধ হয় সেটা পছন্দ হল না। সে প্রথমে মায়ের চারপাশে লাফালাফি করল, তারপর বুকের উপর লাফিয়ে উঠে চুল ধরে টানতে লাগল; অর্থাৎ যতরকমে সম্ভব মাকে বিরক্ত করতে শুরু করল। গরিলা-মা প্রথমে কিছু বলেনি, কিন্তু অত্যাচার যখন অসহ্য হয়ে উঠল তখন চোখ বন্ধ রেখেই বাচ্চাকে একটি মৃদু চপেটাঘাত করল সে। থাপ্পড় খেয়ে বাচ্চাটা ফুটবলের মতো গোল হয়ে গড়াতে গড়াতে ছিটকে পড়ল অনেক দূরে! অবশ্য পরিত্রাহি চিৎকার করে সে জানিয়ে দিয়েছিল মায়ের ব্যবহারটা তার মোটেই ভালো লাগেনি।
গরিলা দলপতির গতিবিধি লক্ষ করা কিন্তু এত সহজ নয়। পথ চলার সময়ে সে থাকে দলের আগে। দল যখন পিছিয়ে আসে, সে তখন সকলের পিছনে। দলের গরিলারা যখন আহারে ব্যস্ত, দলপতি সেইসময় চারধারে ঘুরে ঘুরে টহল দেয়, নজর রাখে চারদিকে শত্রুর আবির্ভাব হলে তার প্রথম মোকাবেলা করে দলপতি। দৈর্ঘ্যে ছয় ফিট ছয় ইঞ্চি, রোমশ কৃষ্ণ দেহের পৃষ্ঠদেশে কালোর বদলে রুপালি রঙের ছোঁয়া-মাখানো বিরাট শরীর নিয়ে গরিলা দলপতি যখন ধীর পদক্ষেপে বনের পথে বিচরণ করে, তখন মনে হয় অরণ্য-সম্রাট তার রাজত্ব পরিদর্শন করে ফিরছে!
গরিলারা যখন স্থানত্যাগ করে অপরস্থানের উদ্দেশে রওনা হত, ঠিক সেইসময় তাদের অনুসরণ করতেন না আত্তিলিও। কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি বুঝেছিলেন পিগমিদের মতো নিঃশব্দে ঘন জঙ্গলের ভিতর চলাফেরা করার ক্ষমতা তার নেই। ভারী জুতো আর ভারী শরীর নিয়ে ধুপধাপ করে বনের মধ্যে যাতায়াত করতে গিয়ে গরিলাদের চমকে দেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাদের মেজাজ খারাপ থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, সে-রকম বিপজ্জনক কিছু না-ঘটলেও অতি দ্রুতবেগে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে তারা যে অনুসরণকারীদের ফাঁকি দেবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।