গরিলা সম্বন্ধে যেসব গল্প শুনেছিলেন আত্তিলিও সেই গল্পগুলো এখন তার মনে পড়তে লাগল। নিগ্রোদের মধ্যে অনেকেই নাকি গরিলার কবলে পুড়ে অদৃশ্য হয়েছে, শ্বেতাঙ্গ শিকারিদের মধ্যে যারা গুলি চালিয়েছে কিন্তু গরিলাকে হত্যা করতে পারেনি এবং তার ফলে গরিলার প্রচণ্ড মুষ্টি যাদের সর্বাঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে তাদের কথা মনে পড়ল আত্তিলিও সাহেবের, গরিলার নখাঘাতে ছিন্নভিন্ন পিগমিদের কাহিনিও তাঁর স্মরণপথে উঁকি দিল, আর
আর ঠিক সেই সময় মটাৎ করে একটা গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ এল আত্তিলিওর বাঁ-দিক থেকে!
বিদ্যুদবেগে শব্দ লক্ষ করে ঘুরলেন তিনি, কিন্তু কিছুই তার নজরে পড়ল না।
আবার একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ এল সামনের দিক থেকে। পরের শব্দটা উঠল ডান দিকে। তারপর এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল সেই শব্দ–কাদের ভারী পায়ের চাপে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে শুকনো গাছের ডাল। সেইসঙ্গে বড়ো বড়ো গাছের পাতার আলোড়ন-ধ্বনি। অরণ্যের বুকে শব্দের তরঙ্গ তুলে সরে যাচ্ছে অনেকগুলো অতিকায় জীব। যদি তাদের মধ্যে কারো হঠাৎ আত্তিলিওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার শখ হয়, তাহলে কী হবে? ঘন উদ্ভিদের জাল ভেদ করে আক্রমণকারীকে আবিষ্কার করার আগেই তো আত্তিলিও পড়ে যাবেন দানবের খপ্পরে! রাইফেল চালানোর সময় পাওয়া যাবে কি?
না, সেসব কিছু হল না। অন্তত এবারের মতো গরিলারা আত্তিলিও আর তার দলবলকে রেহাই দিল। জন্তুগুলো সরে যাচ্ছে।
যে-পাহাড়টার উপর আত্তিলিও তাঁর পিগমি সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই পাহাড়ের নীচের দিকেই সশব্দে নেমে যাচ্ছে গরিলার দল। যাওয়ার আগে তারা বুঝি জানিয়ে দিয়ে গেল, সাবধান! চলে যাও এখান থেকে! কথা না-শুনলে বিপদ হবে!
হ্যাঁ, চলে যেতেই চাইলেন আত্তিলিও। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাতে তার একটু সময় লাগবে। সেদিন অন্তত দানব-গরিলার সান্নিধ্যে আসার জন্য একটুও উৎসুক ছিলেন না আত্তিলিও, বরং ওই ভয়ংকর জীবের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্যই তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। কম্পাসের দিকে তাকিয়ে তিনি পিছন ফিরে তাঁবুর দিকে যাত্রা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন পিগমি-সর্দারের কাছে। সর্দার কাসিউলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, তারপর সোজা এগিয়ে চলল নিজের খুশিমতো। পিছন ফিরে তাবুর রাস্তায় পা বাড়াল । আত্তিলিওর মেজাজ খারাপ হল; লোকটা আবার কিশোয়াহিলি ভাষা ভালো বুঝতে পারে না, কিন্তু ওই ভাষা ছাড়া আর কীভাবে আত্তিলিও ভাব প্রকাশ করবেন? এত তাড়াতাড়ি তো আর পিগমিদের ভাষা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। অতএব বার বার হাত নেড়ে পূর্বোক্ত ভাষাতেই তিনি বলতে লাগলেন, তোমাকে পিছন ফিরতে বলছি না? আমি তাঁবুতে ফিরতে চাই।
সর্দার কাসিউলা খুব অমায়িকভাবে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ আত্তিলিওর কথা সে বুঝেছে। কিন্তু যে-পথ ধরে এগিয়ে গেলে তাবুতে পৌঁছানো যাবে বলে ভাবছিলেন আত্তিলিও, ঠিক তার উলটো দিকের পথ ধরেই হাঁটতে লাগল কাসিউলা! এমন নির্বিকার মানুষকে নিয়ে কী করা যায়? উপায়ান্তর না-দেখে আত্তিলিও শেষ পর্যন্ত কাসিউলাকেই অনুসরণ করলেন। ফলে দেখা গেল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি এসে পড়েছেন তাবুর সামনে! আত্তিলিও বুঝলেন কম্পাস প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্য না-নিয়েও পিগমিরা নিখুঁতভাবে পৃথ চলতে পারে। শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও পিগমিরা কখনো পথ ভুল করে না। সত্যি, তাদের দিকনির্ণয় করার ক্ষমতা অদ্ভুত।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বামন ও দানবের দেশ
কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। আত্তিলিও দানব-গরিলার স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারলেন। কিন্তু দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পিগমিদের মতো সহজভাবে পথ চলার কায়দাটা রপ্ত করতে পারলেন না। প্রত্যেকদিন অরণ্য ভ্রমণ সাঙ্গ করে আত্তিলিও ভাবতেন, আর নয়, এবার অন্তত কয়েকটা দিন বিশ্রাম নেব।
পরের দিন কাসিউলা এসে ডাকামাত্র তিনি আবার বেরিয়ে পড়তেন, রহস্যময় অরণ্য যেন দুর্বার আকর্ষণে তাকে টেনে আনত তাবুর বাইরে।
প্রত্যেকদিন কাসিউলা তার শ্বেতাঙ্গ অতিথিকে নিয়ে যেত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। ওই জায়গাগুলো ছিল গরিলাদের রাতের আস্তানা। তারা চলে যাওয়ার পর তাদের পরিত্যক্ত আস্তানা পর্যবেক্ষণ করে আত্তিলিও দুটি গরিলা-পরিবারের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছিলেন। পরিবার দুটি দিনের বেলা একসঙ্গে ভ্রমণ করত, কিন্তু রাত হলে তারা আশ্রয় নিত পৃথক আস্তানায়।
ওই আস্তানাগুলো তৈরি করতে গরিলারা যথেষ্ট পরিশ্রম করত। দুটি বড়ো গাছের নীচে রাত্রিবাসের জন্য আস্তানা তৈরি করা হত। প্রথমে গাছের তলায় মাটির উপর থেকে ঝোঁপঝাড়, শিকড়বাকড় তুলে জায়গাটা পরিষ্কার করত গরিলারা, তারপর সেই জায়গাটার উপর প্রচুর পরিমাণে শ্যাওলা, গাছের পাতা প্রভৃতি বিছিয়ে প্রস্তুত করত একটি আরামদায়ক বিছানা। অন্তঃপুরের গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টাও ছিল–মোটা মোটা লায়ানা লতা টেনে এনে পর্দা দেওয়ার চেষ্টা দেখা যেত ওই আস্তানায়।
গরিলাদের সঙ্গে যখন ছোটো বাচ্চা থাকে তখন মেয়ে-গরিলা আর বাচ্চারা গাছের উপর আশ্রয় গ্রহণ করে। দৈত্যাকৃতি পুরুষ গরিলা গাছের নীচে পূর্বে উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসারে তার নিজের আস্তানা ও শয্যা তৈরি করে, তারপর সেখানে নিদ্রা দেয়। তবে একবারে চিতপাত হয়ে তারা শুয়ে পড়ে না, গাছের গুঁড়িতে পিঠ লাগিয়ে তারা নিদ্রাসুখ উপভোগ করে। ঘুমের সময়েও বিপদের আশঙ্কায় তাদের ইন্দ্রিয় থাকে অতিশয় জাগ্রত, একেবারে অচৈতন্য হয়ে তারা কখনোই নিদ্রার ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করে না।