পিগমিরা এর মধ্যে গাছের ডালপালা দিয়ে একটা সাময়িক আচ্ছাদন নিজেদের জন্য তৈরি করে ফেলেছে এবং অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে আত্তিলিওর রাঁধুনির রান্নার স্বাদ গ্রহণ করছে। নিবিষ্টচিত্তে। রান্না তো ভারি, গাদা গাদা সিদ্ধ আঁটা। কিন্তু সেই খাদ্য পেয়েই তারা খুব খুশি, আর রাঁধুনিও তাদের পরিতুষ্ট করতে ব্যস্ত। একটু আগেই তার অট্টহাস্য যে পিগমিদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল সেই কথা সে ভোলেনি, অপ্রীতিকর ব্যাপারটা মুছে ফেলে সে পিগমিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ন্গাগি
খুব ভোরে বীভৎস চিৎকারের শব্দে আত্তিলিওর ঘুম ভেঙে গেল। এমন উৎকট আওয়াজ আগে কখনো শোনেননি তিনি। তবু চিৎকারের কার্যকারণ অনুমান করতে তার ভুল হল না। চটপট তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন আত্তিলিও। পিগমিরা আগেই উঠেছে এবং অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে পড়েছে।
উত্তেজিত স্বরে আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, নগাগি?
পিগমিদের নেতা কাসিউলা গম্ভীরভাবে বলল, নদিও, নগাগি (হ্যাঁ, গরিলা)।
সমবেত পিগমিরা মাথা নেড়ে সর্দারের কথায় সায় দিল। তার পর সদ্য জাগ্রত শিশু সূর্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। আত্তিলিওর পায়ের তলায় অবস্থিত উঁচু জমিটার অনেক নীচে কিভু হ্রদের জল যেখানে আয়নার মতো ঝকঝক করছে, মনে হল সেই তরল আয়নার উপর থেকেই উঠে আসছে প্রভাত সূর্য।
কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন আত্তিলিও। সঙ্গে রইল খর্বকায় পিগমি পথপ্রদর্শকের দল। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে আত্তিলিও ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু এমন কষ্টকর পথ চলার অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি। পথ বলতে কিছু নেই–ঘন সন্নিবিষ্ট বৃক্ষ, ঝোঁপ, লতা, ঘাসজঙ্গল প্রভৃতি নিয়ে গঠিত উদ্ভিদের প্রাচীর ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতি মুহূর্তে মনের মধ্যে জেগে ওঠে সর্পাঘাতের সম্ভাবনা। মাথার উপর ডালপালা আর লায়ানা লতার মধ্যে সাপ লুকিয়ে থাকলে তাকে ছোবল মারার আগে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়; পায়ের কাছে যেখানে শুকনো ঝরা পাতা আর শ্যাওলার মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় সেখান থেকেও লুকিয়ে-থাকা সাপ যেকোনো মুহূর্তে ছোবল বসাতে পারে শুধু তাই নয়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে যদিও ঘন জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না, তবু প্রতি মুহূর্তে ঝোঁপঝাড়ের ভিতর থেকে আত্মগোপনকারী হিংস্র পশুর আক্রমণের আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা চমকে চমকে উঠতে থাকে, সেইসঙ্গে চোখে পড়ে বিষাক্ত কীটপতঙ্গের আনাগোনা। কয়েকটা বিচিত্র ধরনের কীট আত্তিলিওর পরিচিত নয়, সেগুলোকে তার আরও বেশি ভয়ানক বলে মনে হল। কাটাগাছের ডালগুলো তাদের ধারালো আলিঙ্গনের চিহ্ন বসিয়ে দিতে লাগল আত্তিলিওর পরিচ্ছদ আর চামড়ার উপর, অসংখ্য নাম-না-জানা গাছের বিষাক্ত স্পর্শে ফুলে ফুলে উঠল তার মুখ আর হাত, সঙ্গেসঙ্গে আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বালা-যন্ত্রণা। এর ওপর আবার শ্বাসকষ্টও ছিল–উচ্চভূমির ভারী বাতাস টানতে তার বিলক্ষণ কষ্ট হচ্ছিল, কয়েক ঘণ্টা পথ চলার পরই তার দৃষ্টি হয়ে এল ঝাপসা, কান করতে লাগল ভো ভো! দাঁতে দাঁত চেপে রাইফেল আঁকড়ে ধরে অতিকষ্টে এগিয়ে যেতে। লাগলেন আত্তিলিও সাহেব।
আত্তিলিওর সঙ্গী কাসিউলা নামক পিগমিদের নেতা এবং তার বারোজন অনুচর খুব সহজেই পথ চলছিল। উদ্ভিদের জটিল জালের ভিতর দিয়ে তাদের ছোটোখাটো শরীর চটপট পথ করে নিচ্ছিল, কিন্তু মস্ত গুরুভার দেহ নিয়ে আত্তিলিও যাচ্ছিলেন আটকে আর আটকে তিনি যখন গাছপালার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে পথ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন এবং পায়ের তলায় গর্তগুলো দেখতে না-পেয়ে ধপাধপ আছাড় খাচ্ছেন, পিগমিরা তখন হালকা শরীর নিয়ে গর্তের উপরের। ঘাসপাতা মাড়িয়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে! তাদের জুতো ছাড়া খালি পা খুব সহজেই নরম মাটি, শ্যাওলা ও শিকড়বাকড়ের উপর চেপে পড়ছে কিন্তু আত্তিলিও সাহেবের জুতো-পরা পা যাচ্ছে পিছলে আর পিছলে, তিনি খাচ্ছেন হোঁচটের পর হোঁচট! জঙ্গলের ছায়ার মতোই নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে পিগমিরা, আবার ফিরে এসে সর্দারকে সামনের পথের খবরাখবর দিচ্ছে ফিসফিস করে, তারপরই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে ভূতুড়ে ছায়ার মতো!…
আচম্বিতে আত্তিলিওর খুব কাছেই জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল এক তীব্র চিৎকার! ক্রুদ্ধ সিংহের গর্জনের চাইতেও ভয়ংকর, যাতনাকাতর কুকুরের কান্নার চাইতেও করুণ, মরণাহত মানুষের আর্তনাদের চাইতেও ভয়াবহ সেই চিৎকারের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সকাল বেলা যে চিৎকার শুনেছিলেন আত্তিলিও, এই শব্দটা মোটেই সে-রকম নয়। প্রথম চিৎকারের পরেই খুব কাছ থেকে আরও অনেকগুলো কণ্ঠের সাড়া পাওয়া গেল–কণ্ঠস্বরগুলো একইরকম তীব্র, একইরকম উগ্র, একইরকম ভয়ংকর! তারপর আবার সব চুপচাপ!
চিৎকারগুলো যে গরিলাদের কণ্ঠ থেকেই এসেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু জন্তুগুলো কোথায় অবস্থান করছে বুঝতে পারলেন না আত্তিলিও। গাছের পাতার কম্পনও তাঁর চোখে পড়ল না, তাই তাদের গতিবিধিও ধরতে পারলেন না তিনি–তবে একটা উগ্র গন্ধ তার নাকে এসেছিল বটে। আত্তিলিও ভাবতে লাগলেন এই বুঝি একজোড়া রোমশ বাহু জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরে!