সাহেব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিষিদ্ধ বনভূমিতে বাস করার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। নির্দিষ্ট তিন মাসের মধ্যে একটি দানব-গরিলা শিকারের অনুমতিও নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। তবে নিছক শিকারের বাসনা চরিতার্থ করতে গেলে সরকারের অনুমতি পাওয়া যেত না–আত্তিলিও সাহেব নিহত গরিলার দেহ নিদর্শন হিসাবে প্রেরণ করতে চেয়েছিলেন এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটির নাম উইটওয়াটারসর্যান্ড ইউনিভার্সিটি অর জোহানেসবার্গ।
দেরির জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন আত্তিলিও। চিকিৎসক যেদিন পায়ের অবস্থা সন্তোষজনক বলে রায় দিলেন, সেইদিন সন্ধ্যার সময়ে আত্তিলিও সাহেবপ্রাদেশিক কমিশনারের সঙ্গে দেখা করলেন। কমিশনারের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া গেলেও যেসব কথা উক্ত ভদ্রলোকের মুখ থেকে শুনেছিলেন আত্তিলিও, সেগুলো তার কানে আদৌ মধুবর্ষণ করেনি।কমিশনার সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন একটির বেশি গরিলাকে কোনো কারণেই হত্যা করা চলবে না। আত্মরক্ষার ছুতো তিনি শুনতে রাজি নন, কারণ এর আগে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ জঙ্গলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেকগুলো গরিলাকে হতাহত করেছে। আহতদের সংখ্যা নিহতের চাইতে বেশি। হত্যাকারীরা অবশ্য বলেছে আত্মরক্ষার জন্যই তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু কমিশনার তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। কমিশনার সাহেব আত্তিলিওকে জানিয়ে দিলেন ওই ধরনের ঘটনা ঘটলে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। কঠোর শাস্তিটা কীরকম হতে পারে জানতে চেয়ে আত্তিলিও শুনলেন অর্থদণ্ডের পরিমাণ খুব কম করে বিশ হাজার ফ্রাঙ্ক এবং কঙ্গো থেকে বহিষ্করণ। অবশ্য বহিষ্করণের আগে একবার জেল খাটতে হবে, তবে জেলের মেয়াদ কতদিন হতে পারে সে-বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছেন না কমিশনার।
জেল! জরিমানা! বহিষ্করণ!–আত্তিলিও হতভম্ব।
কমিশনার বিনীতভাবে জানালেন একটু কড়াকড়ি করতে হয়েছে। গরিলারা দুষ্প্রাপ্য জীব, বিশেষ করে অতিকায় দানব-গরিলা অতিশয় দুর্লভ তাই সরকার তাদের রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ঠিক আছে, আত্তিলিও বললেন, আপনার অমূল্য গরিলাদের মধ্যে একটির বেশি জন্তুকে লক্ষ করে আমি গুলি ছুড়ব না। প্রাণ গেলেও আমার কথার নড়চড় নেই জানবেন।
আত্তিলিও চলে এলেন। কমিশনার তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। স্থানীয় অধিবাসীরা উচ্চভূমিতে অবস্থিত জঙ্গলের কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছিল, ভিতরে যাওয়া তো দূরের কথা। কমিশনারের চেষ্টাতেই কয়েকটি নিগ্রো আত্তিলিওর সঙ্গী হতে রাজি হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে ওই ভদ্রলোকের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করলেন আত্তিলিও।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মাম্বুটি পিগমি
সারাদিন ধরে অত্যন্ত ধীরে ধীরে আর কষ্টকরভাবে পথ চলার পর আত্তিলিও সদলবলে এসে পৌঁছালেন পাহাড়ের উপর একটা সমতলভূমিতে। ওই সমতলভূমির পিছনে বিরাজ করছিল অরণ্যের সবুজ প্রাচীর। খোলা জায়গাটার উপর সকলে এসে দাঁড়াতেই আত্তিলিওর অনুচরদের ভিতর থেকে উঠল প্রবল হাস্যধ্বনি। হঠাৎ লোকগুলোর এমন হাসিখুশি হয়ে ওঠার কারণটা কী হতে পারে ভেবে এদিক-ওদিক দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ পড়ল একদল অতি খর্বকায় মানুষের দিকে। সেই বেঁটে বেঁটে বামনদের দেহে ছিল নামমাত্র আবরণ, তাদের উচ্চতা ছিল চার ফিটের মতো বামনদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা লোকটির দৈর্ঘ্য চার ফিট ছয়-ইঞ্চির বেশি হবে না। লোকগুলোর ছোটো ছোটো কুঞ্চিত মুখের সঙ্গে বাঁদরের মুখের সাদৃশ্য খুব বেশি। ওইরকম কুৎসিত মুখ, খর্বকায় দেহের মধ্যস্থলে সুগোল উদরের স্ফীতি আর সরু সরু পা দেখে মামুটি পিগমি জাতিকে যদি কেউ খুব হাস্যকর বলে মনে করে তাহলে তাকে বোধ হয় দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু মাষুটি পিগমিদের দলে যে ছোটোখাটো বৃদ্ধটি ছিল, সে আত্তিলিওর নিগ্রো অনুচরদের হাস্যস্রোত পছন্দ করল না। বৃদ্ধের মাথা থেকে ঝুলছিল একটা বেবুনের চামড়া, তার নাকের গড়নও ছিল অদ্ভুত হাড়ের উপর-অংশ চেপটা, তলার দিকটা হঠাৎ ঠেলে উঠেছে উপর দিকে। দুই চোখে বন্য উগ্রতার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে পূর্বোক্ত নিগ্রোদের দিকে একবার কটাক্ষপাত করল বৃদ্ধ–এমন ভয়ংকর সেই চোখের প্রভাব যে, তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল হাস্যধ্বনি, সকলের মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্যের নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি।
ইয়াম্বো, বাওয়ানা (সুপ্রভাত, মহাশয়), বৃদ্ধ বলল।
বলার সঙ্গেসঙ্গে হাতের বর্শাতে ভর দিয়ে সে হেলে দাঁড়াল।
তার দুই চোখ এখন আত্তিলিওর দিকে। দৃষ্টিতে বন্ধুত্বপূর্ণ কৌতূহলের আভাস। কেউ বৃদ্ধের পরিচয় না-দিলেও আত্তিলিও বুঝলেন সে হচ্ছে পিগমিদের অধিনায়ক সুলতানি কাসিউলা–কয়েকদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে আত্তিলিওর জন্য।
ইয়াম্বা, বাওয়ানা, বৃদ্ধের সঙ্গীরা সমস্বরে অভ্যর্থনা জানাল। চোখের ভাষা যে পড়তে জানে সে পিগমিদের ঝকঝকে চোখগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝবে বামনরা নির্বোধ নয়। একটু পরেই যে নবাগত সাদা-চামড়ার মানুষটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেই আগন্তুককে দুই চোখ দিয়ে জরিপ করে নিচ্ছে খর্বকায় পিগমিরা বুঝে নিতে চাইছে লোকটি কেমন হবে।
মুহূর্তের মধ্যেই পিগমিদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন আত্তিলিও। ছোটোখাটো লোকগুলোকে তার খুব ভালো লেগে গেল। পিগমিরা আত্তিলিওর মনোভাব বুঝতে পারল। তৎক্ষণাৎ তারা তাবু ফেলার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁবু খাটানোর কাজ শেষ। মোটবাহকরা চটপট শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পারিশ্রমিক নেবার জন্য। প্রাপ্য অর্থ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই লোকগুলো দৌড় দিল–লোভনীয় বকশিশ টম্বাকো (তামাক) নেবার জন্য তারা এক মুহূর্ত দেরি করল না। তাদের অদ্ভুত আচরণের অর্থ খুবই পরিষ্কার আত্তিলিওর কাছে রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই লোকগুলো স্থান ত্যাগ করতে চায়। তাদের বিবেচনায় এই অঞ্চল রাত্রিকালে ঘোরতর বিপজ্জনক।