আমি তোমায় বলেছিলাম কি না? প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে বন্ধুবর বলল, ঠিক চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতোই সহজ হবে সমস্ত ব্যাপারটা এখন দেখলে তো?
হ্যাঁ, সবই দেখলেন আত্তিলিও, সবই শুনলেন। পরে তিনি বন্ধুকে কী বলেছিলেন জানি না। কারণ আত্তিলিও গত্তি তার আত্মজীবনীতে সেসব কথা লিপিবদ্ধ করেননি। তবে বাকশক্তি ফিরে পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তিনি যে বন্ধুকে বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত করে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন এ-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ এবং সেই ভাষণের ফলে উভয়ের বন্ধুত্ব খুব গাঢ় হয়েছিল বলেও মনে হয় না।
৪. শত্রু – দ্বিতীয় খণ্ড
সৈনিকের চতুর্থ অভিজ্ঞতা
শত্রু – দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – নূতন অভিযানের উদ্যোগ
এই কাহিনীর প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি আফ্রিকাবাসী যাবতীয় মহিষকেই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শত্রু বলে মনে করতেন। মহিষ সম্বন্ধে কমান্ডার সাহেবের এমন অদ্ভুত বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠার মূলে যেসব কার্যকারণ বর্তমান ছিল, সেইসব ঘটনার বিবরণ প্রথম খণ্ডের পাঠকদের অজানা নয়। রাইফেলে সিদ্ধহস্ত শ্বেতাঙ্গ সৈনিক ও শৃঙ্গধারী মহাকায় মহিষের মধ্যে স্থাপিত তুলনামূলক শত্রুতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় উভয়পক্ষই আঘাত হানতে বিলক্ষণ পটু, জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল প্রাকৃতিক পরিবেশ আর যোদ্ধাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর–অতএব এই শত্রুতা সমানে-সমানে হয়ে ছিল বললে বোধ হয় সত্যের অপলাপ হয় না। কিন্তু পরস্পরবিরোধী যে দুটি শত্রুর সংঘাতের ফলে বর্তমান কাহিনির অবতারণা তাদের মধ্যে এক পক্ষ ছিল দানবের মতো বিপুল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী–অপরপক্ষ খর্বকায় দুর্বল, নগণ্য; মহাবলিষ্ঠ শত্রুর এক চপেটাঘাতেই তার মৃত্যু ছিল অনিবার্য।
অতিকায় দানব ও খর্বকায় মানবের অসম শত্রুতার ফলে ক্ষুদ্রদেহধারী বামনের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে হলেও শেষ পর্যন্ত বামনই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। যে-অস্ত্রের সাহায্যে এমন অসাধ্যসাধন করতে সে সমর্থ হয়েছিল, সেই অস্ত্রটি হচ্ছে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আত্তিলিও সাহেব পূর্বোক্ত দুই শত্রুর মাঝখানে এসে পড়েছিলেন নিতান্ত ঘটনাচক্রের শিকার হয়ে, রাইফেল হাতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবেলাও করেছিলেন তিনি আদর্শ সৈনিকের মতো কিন্তু এই কাহিনির নায়ক নন আত্তিলিও গত্তি। প্রকৃত নায়কের সম্মান কাকে দেওয়া যায় সেই বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে আমি এইবার কাহিনি শুরু করল্লাম সেখান থেকে, যেখানে ঠ্যাং ভেঙে আত্তিলিও তাঁবুর ভিতর শয্যাগ্রহণ করেছেন।
হ্যাঁ, শয্যা না-গিয়ে আর উপায় কী? মহিষের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে তাঁর শ্রীচরণের যে কী দুরবস্থা হয়েছিল সে-কথা নিশ্চয়ই প্রথম খণ্ডের পাঠকদের মনে আছে। মধ্য আফ্রিকার বাকাভা অঞ্চলে অবস্থিত কিভু নামক বৃহত্তম হ্রদের তীরে তাবুর ভিতর শুয়ে আত্তিলিও তাঁর ভাঙা পা সুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর স্বপ্ন দেখছিলেন।
স্বপ্নের বিষয়বস্তু অবশ্য অন্য লোকের কাছে খুব মনোরম লাগবে না। আত্তিলিওর স্বপ্ন যদি চোখের সামনে নিরেট দেহ নিয়ে দাঁড়ায়, তবে অধিকাংশ মানুষই যে আতঙ্কে চমকে উঠবে । সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আত্তিলিও সাধারণ মানুষ নন, বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার উদ্দেশ্যেই তিনি শ্বাপদসংকুল অরণ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন তাই দূরে দৃশ্যমান অরণ্যসজ্জিত পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে তিনি যে-জীবটির স্বপ্ন দেখতেন, সে হচ্ছে আফ্রিকা তথা সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম বানরজাতীয় জীব–দানব-গরিলা।
কিভু হ্রদের অদূরে বিরাজমান ওই পর্বতশ্রেণির উপর হাজার হাজার বছর ধরে যে মহারণ্য রাজত্ব করছে, সেখানে কোনো মানুষ বাস করে না। অতি দুঃসাহসী পিগমি জাতিও সেখানে কেবলমাত্র দিনের আলোতে প্রবেশ করতে সাহস পায়। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যের নিবিড় অন্তঃপুর থেকে প্রতি প্রভাতে শিশু-সূর্যকে অভিনন্দন জানিয়ে তীব্রস্বরে ডেকে ওঠে দানব-গরিলা। মানুষের যাতনা-কাতর আর্তনাদের মতো অতিকায় কপিকণ্ঠের সেই রবি-বন্দনা কানে গেলে শ্রোতার সর্বাঙ্গে জেগে ওঠে আতঙ্কের শিহরন! ওইভাবে চিৎকার করে প্রভাত-সূর্যকে অভ্যর্থনা জানায় বলেই স্থানীয় মানুষ গরিলার নাম দিয়েছে গাগি অর্থাৎ রাত্রির যে অবসান ঘটায়। গরিলার কণ্ঠস্বরে সাড়া দিতেই যে সূর্যদেব প্রত্যহ পূর্বাচলে আত্মপ্রকাশ করেন এ-বিষয়ে পিগমি জাতির সন্দেহ নেই কিছুমাত্র।
পিগমিরা দু-দুবার খবর পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তারা আত্তিলিওকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক, তাঁর জন্য তারা অপেক্ষা করছে সাগ্রহে। পিগমিদের খবর পেয়ে গরিলার সন্ধানে যাত্রা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে তখনই অভিযান শুরু করতে পারছিলেন না।
তাঁর মানসিক অবস্থা বোধ হয় আহত অঙ্গটিকে আরোগ্য লাভ করতে সাহায্য করেছিল, কারণ অপ্রত্যাশিতভাবে চিকিৎসক তাকে জানালেন গোড়ালির হাড় জোড়া লেগে গেছে, আত্তিলিও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
বেলজিয়ামের উপনিবেশ-মন্ত্রীর হাত থেকে অনেক কষ্টে দানব-গরিলার বাসস্থানে প্রবেশ করার একটা পারমিট বা ছাড়পত্র আদায় করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও।ওই অঞ্চলে প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া খুব কঠিন, তবে কয়েকটা অভিযানে সাফল্য লাভ করেছিলেন বলেই আত্তিলিও