তিন বন্ধু হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তারা তিনজন ছাড়া আশেপাশে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই, নিগ্রো চাকররা সবাই অদৃশ্য হয়েছে।
না, সবাই নয়, জামানি নামক জুলু জাতীয় যে রাঁধুনিটি অভিযাত্রীদের একান্ত বিশ্বাসের পাত্র ছিল, সেই লোকটি স্থান ত্যাগ করে পালায়নি। পলাতক পাঁচটি চাকরই ছিল উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় অধিবাসী। প্রফেসরের মুখে কায়না শব্দটি শোনার সঙ্গেসঙ্গেই ছোকরা চাকর সকলের কাছে সেই সংবাদ বিতরণ করেছে এবং তার ফলেই বিহ্বল হয়ে মানুষগুলো যে গা-ঢাকা দিয়েছে, এ-বিষয়ে অভিযাত্রীদের কোনো সন্দেহ ছিল না।
রাতের লোভনীয় খাদ্য মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে, চাকররা উধাও হয়েছে জিনিসপত্র ফেলে, তিন বন্ধুর চোখ-মুখ কিন্তু আনন্দে উজ্জ্বল। একটা স্পষ্ট সত্য তারা বুঝতে পেরেছেন : ভৃত্যদের দারুণ আতঙ্ক প্রমাণ করেছে মৃত্যুগহ্বর অলীক কল্পনা নয়। বাস্তব জগতেই বিরাজ করছে ওই ভয়-দেখানো ভয়ানক কায়না।
শুকনো খাদ্যের টিন খুলতে খুলতে অভিযাত্রীরা প্রতিজ্ঞা করলেন, কায়না নামের ওই বিভীষিকাকে যেমন করেই হোক তারা আবিষ্কার করবেন।
প্রতিজ্ঞা করা সহজ, প্রতিজ্ঞা রাখা সহজ নয়।
উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় মানুষ মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের এড়িয়ে চলতে লাগল। মাম্বোয়া জাতির কোনো লোকের কাছে পথের সন্ধান চাইলে সে ভুল পথের নির্দেশ দিত, কাজ করতে বললে পলায়ন করত ঊধ্বশ্বাসে। চারদিক থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত তিন বন্ধুর কানে, এখানে-ওখানে চোখে পড়ত শূন্যে ভাসমান ধোঁয়ার কুণ্ডলী মাম্বোয়াদের সংকেত।
অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য এখন আর মাম্বোয়াদের অজানা নয়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ভেসে যায় ধোঁয়ার অক্ষরে লেখা কুণ্ডলীপাকানো দুর্বোধ্য সতর্কবাণী–সাবধান! সাদা মানুষ এসেছে মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে।
ঢাকের আওয়াজ ও ধোঁয়ার সাংকেতিক অর্থ সঠিকভাবে বোধগম্য না হলেও মাম্বোয়াদের মনোভাব অভিযাত্রীরা বুঝতে পেরেছিলেন।
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেও জনপ্রাণীর সাক্ষাৎ পেলেন না তিনবন্ধু। অভিযাত্রীদের আগমন-সংবাদ আগেই পেয়ে যেত গ্রামবাসীরা এবং সঙ্গেসঙ্গে তারা যে স্থান ত্যাগ করত সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই! অভিযাত্রীরা বুঝলেন, মাম্বোয়া-জাতি তাদের বয়কট করছে!
অবশেষে তারা জেলা-কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বললেন। কমিশনার তাঁদের কথা শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন এবং সক্রিয়ভাবে অভিযাত্রীদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু মাম্বোয়াদের মধ্যে যারা কমিশনারের একান্ত অনুগত ছিল, তারাও তাঁর কথায় অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিতে রাজি হল না। অবশেষে চারজন মাম্বোয়া বন্দি অভিযাত্রীদের দলে কাজ করতে সম্মত হল। তারা বোধ হয় ভেবেছিল, দিনের পর দিন বন্দি অবস্থায় গাধার খাটুনি না-খেটে (ওই সময়ে একটা রাস্তা তৈরির কাজে তারা নিযুক্ত ছিল) যদি পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছু অর্থ উপার্জন করা যায়, তাহলে ক্ষতি কী? তা ছাড়া, ভালোভাবে কাজ করলে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জেলা কমিশনার। অতএব বন্দি চারজন মহা উৎসাহে অভিযাত্রীদের দলে যোগ দিল।
ইতিমধ্যে কমিশনার সাহেবের সঙ্গে অভিযাত্রীদের দস্তুর মতো বন্ধুত্ব পেয়ে গেছে। কমিশনার বেশ বুদ্ধিমান মানুষ, তিনি রটিয়ে দিলেন গুহাবাসী জন্তুজানোয়ার দেখার জন্যই অভিযাত্রীরা এই অঞ্চলে পদার্পণ করেছেন। ধাপ্পায় কাজ হল; মাম্বোয়ারা অভিযাত্রীদের সঙ্গে কিছুটা সহজভাবে মেলামেশা শুরু করল। তিন বন্ধু এবার সাবধান হয়েছেন। কায়নার নাম-মাহাত্ম্য যে বিপত্তির সূচনা করেছিল, তা এত শীঘ্র ভুলে যাওয়ার কথা নয়–কেউ আর কায়নার নাম মুখে আনতেন না।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – গুহাতে মৃত্যুর হানা
কায়না-অভিযান ভালোভাবে চালানোর জন্য একটা মানচিত্রের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উক্ত বস্তুটিকে কোথাও পাওয়া গেল না বলে অভিযাত্রীরা ঠিক করলেন, তারা নিজেরাই এলাকাটা পরিদর্শন করে একটা চলনসই মানচিত্রের খসড়া তৈরি করে নেবেন।
কাজটা দু-চার দিনের মধ্যে হওয়ার নয়, বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই যে কয়দিন ওটা তৈরি না হয়, সেই কয়দিনের জন্য একটা স্থায়ী আস্তানার প্রয়োজন। অতএব স্থায়ীভাবে একটা তাবু খাটানো হল। তবুটা যেখানে পাতা হয়েছিল সেই জায়গাটার চারিদিকে পড়েছিল অজস্র গ্রানাইট পাথর। সমস্ত অঞ্চলটা যেন গ্রানাইট পাথরের রাজত্ব–যেদিকে চোখ যায় খালি পাথর আর পাথর।
একটা তাবু খাঁটিয়েই কাজ শেষ হল না। জিনিসপত্র সাজসরঞ্জাম মজুত করার জন্য কয়েকটা কুঁড়েঘর তোলা দরকার। কিন্তু শক্ত পাথুরে-মাটির ওপর খুঁটি পুঁতে ঘর তোলা কি দু-চারজনের কাজ? তা ছাড়া বাক্স-বন্দি অজস্র সাজসরঞ্জাম বহন করার জন্যও তো কিছু লোকের দরকার। খুঁটিনাটি আরও যেসব কাজ ছিল তার জন্যও লোক চাই, অর্থাৎ বেশ কিছু জনমজুর না হলে অভিযাত্রীদের আর চলছে না।
তিন বন্ধুর সঙ্গে যে চারজন মাদোয়া-বন্দি কাজ করার জন্য এসেছিল, তাদের, এবার পদোন্নতি ঘটল। খাটুনির কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে আত্তিলিও তাদের জনমজুর সংগ্রহ করার কাজে নিযুক্ত করলেন তারা হয়ে গেল রিক্রুটিং অফিসার!
কাজটা তাদের খুব পছন্দ হয়েছিল; ওই কাজে তারা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিল। মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক এবং নানারকম উপহার পেয়ে মাম্বোয়ারা ভারি খুশি; সেই সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই লুব্ধ জনতার স্রোত এমনভাবে বাড়তে লাগল যে মাসখানেক পরেই অভিযাত্রীরা দেখলেন লোকের অভাবে বিপন্ন হওয়ার কোনো কারণ আর নেই।