অ্যাংকোলেকে পরীক্ষা করেছিল একটি মহিষ, তাকে পরীক্ষা করতে আসবে আড়াইশো মহিষের বিপুল বাহিনী।
নাঃ, অসম্ভব, আত্তিলিওর পক্ষে মড়ার ভান করে এই চতুষ্পদ মৃত্যুদূতদের ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার সুপ্তচেতনা ভেদ করে জাগ্রত চৈতন্যের দ্বারে আঘাত করল এক আধপাগলা ইংরেজ শিকারির কণ্ঠস্বর–মনে রেখো, ওরা মাথা তুলে রাখে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওরা মাথা তুলে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করে..
হ্যাঁ, উপায় আছে! একটিমাত্র পন্থা অবলম্বন করলে হয়তো যমদূতদের কবল থেকে উদ্ধার লাভ করা সম্ভব নতুন আশায় বুক বাঁধলেন আত্তিলিও। মহিষ চরম আঘাত হানবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মাথা তুলে শত্রুকে লক্ষ করে; অতএব ধাবমান মহিষযূথকে যদি তিনি হঠাৎ চমকে দিতে পারেন, তবে হয়তো জন্তুগুলো তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারে।
আত্তিলিও জানতেন মহিষের চক্ষু বিবর্ধক শক্তিসম্পন্ন। তার সামান্য গতিবিধি তাদের চোখে ধরা পড়বে অসামান্য দ্রুতবেগে বর্ধিত আকারে–অতএব দুই হাত নেড়ে যদি তিনি তাদের ভড়কে দিতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো এযাত্রা বেঁচে যাবেন। আড়াইশো ধাবমান মহিষের সামনে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবশ্য খুবই কঠিন, কিন্তু হাত নেড়ে চিৎকার করা ছাড়া বর্তমান অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার যখন অন্য উপায় নেই, তখন উপযুক্ত বিপজ্জনক পদ্ধতির আশ্রয়গ্রহণ করার সংকল্প করলেন আত্তিলিও–
এক টান মেরে মাথা থেকে তিনি খুলে ফেললেন হেলমেট, প্রস্তুত হলেন চরম মুহূর্তের জন্য…
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – শরীরী ঝটিকার গতিপথে
পায়ে পায়ে জাগছে ভূমিকম্প, শৃঙ্গে শৃঙ্গে জ্বলছে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ, ধেয়ে আসছে মূর্তিমান মৃত্যুর শরীরী ঝটিকা–
আড়াইশো মহিষের উন্মত্ত বাহিনী!
কখন যে তারা এসে পড়েছে বুঝতে পারেননি আত্তিলিও, তিনি শুধু চিৎকার করছেন গলা ফাটিয়ে আর মাথার হেলমেট খুলে সজোরে নাড়ছেন সেটাকে–ডাইনে, বাঁয়ে, মাথার উপর সর্বত্র! জন্তুগুলো তাঁর এত কাছে এসে পড়েছিল যে, মহিষ দলপতির খোলা চোখ দুটোকেও তিনি দেখতে পেলেন। ভাবলেশহীন নির্বিকার দৃষ্টি মেলে জন্তুটা তার দিকে তাকিয়েছিল নির্নিমেষ নেত্রে। দারুণ আতঙ্কে আত্তিলিও চোখ মুদে ফেললেন, কিন্তু তার হাত দুটো যন্ত্রের মতো ঘুরতে লাগল–ওই অঙ্গ দুটি যেন তাঁর নিজস্ব নয়, হঠাৎ যেন হাতের উপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছেন তিনি–অদৃশ্য এক শক্তি যেন হাত দুটিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার!
মুদিত নেত্রে সজোরে হাত নাড়তে লাগলেন তিনি, সেইসঙ্গে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার চোখে না দেখতে পেলেও তাঁর শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতে লাগল অনেকগুলো গুরুভার দেহের প্রচণ্ড পদধ্বনি। দ্রুত ধাবমান সেই ধ্বনিতরঙ্গ তার দু-পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ডাইনে আর বাঁয়ে… অবশেষে একসময়ে আত্তিলিওর পিছনে বহু দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল বিলীয়মান শব্দের ঢেউ দূরে অপসৃত মৃত্যুর পদধ্বনির মতো…।
যাক! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আত্তিলিও! এই যাত্রা বেঁচে গেছেন তিনি! হাতে রাইফেল না থাকায় তিনি ভেবেছিলেন এইবার মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পরে বুঝলেন নিরস্ত্র ছিলেন বলেই তিনি অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে অব্যাহতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। রাইফেল হাতে থাকলেই গুলি চালাতেন তিনি, কিন্তু লাভ কী হত? কয়েকটা জন্তু গুলি খেয়ে মারা পড়ত, তারপরই তার দেহের উপর দিয়ে ছুটে যেত চতুষ্পদ জনতার জান্তব ঝটিকা–শত শত খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতেন তিনি, প্রান্তরের বুকে একদা-জীবিত মনুষ্যদেহের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পড়ে থাকত দলিত, বিকৃত, রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ড।
মহিষ-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যার অমূল্য উপদেশ যথাসময়ে স্মরণে আনতে পেরে বেঁচে গেলেন আত্তিলিও, সেই ইংরেজ-শিকারি কিন্তু সময়কালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গিয়ে গুলি চালিয়েছিল এবং তার ফলেই মৃত্যুবরণ করেছিল সে। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস।
আত্তিলিও জানতেন বর্তমানে তিনি নিরাপদ। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী নয় সেই নিরাপত্তা। মহিষয়ূথ এখনই আবার ফিরে আসবে। যেভাবে অ্যাংকোলে-শিকারির কাছে ছয়-ছয়বার ঘুরে এসেছিল একক মহিষ জোবি, ঠিক সেইভাবেই তার কাছে ঘুরে আসবে মহিষের দল–পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন আত্তিলিও গত্তি।
অনুমান নির্ভুল। ঘুরে এসেছিল মহিষযূথ। তবে আত্তিলিওকে তারা দেখতে পায়নি। পা ভেঙেছে কি অস্ত আছে সে-বিষয়ে একটুও মাথা না-ঘামিয়ে জ্বালাযন্ত্রণা তুচ্ছ করে তিনি ছুটেছিলেন নদীর দিকে। মহিষগুলো যখন অকুস্থলে ফিরে এসেছিল, আত্তিলিও তখন নদীতীর থেকে বন্দুকবাহকের পরিত্যক্ত রাইফেলটা তুলে নিয়ে ঝাঁপ খেয়েছেন নদীর জলে! প্রায় পাঁচ ফিট গভীর কর্দমাক্ত জলের ভিতর দিয়ে রাইফেলে ভর দিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন এবং অতি কষ্টে নদী পার হয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে শক্ত জমির উপর একসময়ে এসে পড়লেন আত্তিলিও। সঙ্গে সঙ্গে একগাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বেলজিয়ান বন্ধু!
আত্তিলিওর শোচনীয় অবস্থা তার নজরেই পড়ল না। মহানন্দে চিৎকার করে সে বলে উঠল, কী? কেমন দেখলে? আমি তোমায় বলেছিলাম কি না..
আত্তিলিও সাহেবেরও অনেক কিছু বলার ছিল। বলেননি। কারণ কথা বলতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন তাঁর স্বরযন্ত্র কিছুক্ষণ পর্যন্ত মৌনব্রত পালন করতে চায়–অতএব বন্ধু সম্বন্ধে তাঁর যে ব্যক্তিগত অভিমত জানানোর জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, সেই বক্তব্যকে তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেন।