আত্তিলিও মনে মনে তার নবপরিচিত বন্ধুকে ধন্যবাদ দিলেন। সে ঠিক জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে। এখান থেকে ফটো তোলা সবচেয়ে সুবিধাজনক। হাওয়ার গতি অবশ্য ভালো নয়, তবে মহিষরা যে তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে না সে-বিষয়ে আত্তিলিও গত্তির মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।
চব্বিশটা আলোকচিত্র গ্রহণ করার পর আত্তিলিও ক্যামেরার স্বয়ংক্রিয় ম্যাগাজিন থেকে ব্যবহৃত ফিল্ম সরিয়ে নূতন ফিল্ম সংযোগ করতে সচেষ্ট হলেন। নীচু হয়ে ওই কাজ করছিলেন তিনি। পুরানো ফিল্ম সরিয়ে নতুন ফিল্ম লাগাতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগে। তবে আত্তিলিওর বোধ হয় মিনিট খানেকের উপর আরও ত্রিশ সেকেন্ড লেগেছিল; কারণ, তার পায়ের তলায় তখন জেগে উঠেছে প্রচণ্ড কম্পন–শত শত চলন্ত চতুম্পদের পদাঘাতে মাটি কাঁপছে ভূমিকম্পের মতো!
ক্যামেরাতে নতুন ফিল্ম লাগিয়ে আত্তিলিও আবার উইটিপির আড়াল থেকে মুখ বাড়ালেন। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কের চমক। মহিষযূথ খুব কাছে চলে এসেছে। এমন অপ্রত্যাশিত সান্নিধ্য আত্তিলিওর ভালো লাগল না। জন্তুগুলো তার ডান দিক দিয়ে নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, এখন মনে হচ্ছে তাদের গতিপথ একটু বদলে যাওয়ার ফলেই মহিষয়ূথ তার কাছাকাছি এসে পড়েছে।
অবশ্য জন্তুগুলোর মধ্যে কোনো উত্তেজনা বা উগ্রতার চিহ্ন দেখা দেয়নি। তবু আত্তিলিও ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবে নিতে পারলেন না। মুহূর্তের মধ্যে তিনি কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। মহিষের দল সোজাসুজি নদীর দিকে এগিয়ে গেলেই তিনি আবার ক্যামেরা হাতে নেবেন, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে ততক্ষণ ক্যামেরার চাইতে রাইফেলের সান্নিধ্য বেশি বাঞ্ছনীয়।
দৃষ্টি সামনে রেখে তিনি পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শিকারির প্রসারিত হস্তের এই ইঙ্গিত প্রত্যেক বন্দুকবাহকের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও রাইফেলের স্পর্শ পেলেন না আত্তিলিও সাহেব। সম্মুখে চলমান ভয়ংকর মিছিল থেকে চোখ ফেরানো নিরাপদ নয়, তাই চোখের দৃষ্টি যথাস্থানে রেখেই তিনি চাপা গলায় ডাকলেন–এই!
ফল হল একইরকম, প্রসারিত হস্তের মতো অবরুদ্ধ কণ্ঠের ইঙ্গিতও হল ব্যর্থ–হাতে এসে পৌঁছাল না রাইফেল।
লোকটা কি গাধা নাকি? সক্রোধে দুই চোখে আগুন ছড়িয়ে পিছন ফিরলেন আত্তিলিও, সঙ্গেসঙ্গে তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল বিদ্যুৎ তরঙ্গ–
কেউ নেই পিছনে!
লোকটা যে কখন পালিয়েছে বুঝতেই পারেননি আত্তিলিও। এখন তার দ্রুত ধাবমান দেহটা তার চোখে পড়ল। এর মধ্যেই সে অনেক দূর চলে গেছে, তার শরীরটা দেখাচ্ছে ছোট্ট, নদী থেকে লোকটির দূরত্ব এখন এক-শো গজও হবে না।
আত্তিলিও মনে মনে ভাবলেন, মহিষগুলো নিশ্চয়ই ওকে দেখতে পেয়েছে। সেইজন্যই তাদের গতিপথের পরিবর্তন ঘটেছে।
কিন্তু তার ধারণা যদি সত্য হয় তাহলে তো সমূহ বিপদ। মহিষরা যে-পথ ধরে এগিয়ে আসছে, সেই পথের মাঝখানেই তো রয়েছেন তিনি একটু পরেই তো আড়াইশো মহিষের দল এসে পড়বে তার উপর! এখন উপায়!
বন্দুকবাহক নদীর ধার থেকে একবার আত্তিলিওর দিকে তাকাল, হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল রাইফেলটা সে ওইখানেই রেখে দিয়েছে–তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর মধ্যে। জল ছিটকে উঠল, আর তাকে দেখা গেল না।
আত্তিলিও এইবার মহিষযুথের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারা এগিয়ে আসছে একইভাবে, তবে তাদের গতিবেগ বর্ধিত হয়নি, বেশ হেলেদুলে সহজভাবেই এগিয়ে আসছে তারা।
একটি লোককে ছুটতে দেখেও যখন তারা উত্তেজিত হয়নি, তখন আর একটি লোকের ধাবমান শরীরও বোধ হয় তাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে না–ভাবলেন আত্তিলিও।
দূরত্বটা চোখ দিয়ে মেপে নিলেন তিনি–নিতান্তই যদি তেড়ে আসে, তাহলেও আমাকে ওরা ধরে ফেলার আগেই আমি রাইফেলটার কাছে গিয়ে পড়ব।
সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি ছুটতে শুরু করলেন। সঙ্গেসঙ্গে বন্দুকের আওয়াজ পর পর তিনবার। আত্তিলিও ভাবলেন তার বেলজিয়ান বন্ধু বন্দুকের শব্দে মহিষগুলোর দৃষ্টি অন্যত্র আকৃষ্ট করে তাকে সাহায্য করতে চাইছে। কথাটা ভাবতেই তার মনের জোর বাড়ল, আরও জোরে পা চালিয়ে ছুটতে লাগলেন তিনি।
আবার বন্দুকের শব্দ। ডান পায়ের গোড়ালিতে অসহ্য যন্ত্রণা। ছিটকে পড়লেন আত্তিলিও। ক্যামেরাটা দারুণ জোরে তার বুকে আঘাত করল। মাটিতে আছাড় খেয়ে জ্ব থেকে ঝরতে লাগল রক্তের ধারা। একবার উঠতে চেষ্টা করলেন আত্তিলিও। আর সঙ্গেসঙ্গে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কী হয়েছে। আত্তিলিও ভেবেছিলেন তাঁর পায়ে গুলি লেগেছে, কিন্তু না, তা নয়–পাথরের মতো শক্ত মাটির ফাটলে তার পা আটকে গেছে। ফাটলের গ্রাস থেকে পা টেনে বার করলেন আত্তিলিও। পা মচকে গেছে ভীষণভাবে, গোড়ালির হাড় ভেঙে যাওয়াও আশ্চর্য নয়। মহিষের দল এদিকে ভীষণ উত্তেজিত। গুলি খেয়ে কয়েকটা জন্তু মারা পড়েছে। সমস্ত দলটা এখন আত্তিলিওর দিকেই ছুটে আসছে।
একবার পা ফেলার চেষ্টা করেই থেমে গেলেন আত্তিলিও। নদী সামনে, একটি দৌড় দিলেই তিনি নিরাপদ।
কিন্তু দৌড়ানো তো দূরের কথা, সহজভাবে হেঁটে চলার ক্ষমতাও তার নেই।
সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল অ্যাংকোলে-শিকারির কথা। মড়ার ভান করে পড়ে থেকে সেই লোকটি মহিষকে ফাঁকি দিয়েছিল। অতি দুঃখে আত্তিলিওর হাসি এল। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। তাঁর, সর্বশরীর কাঁপছে থর থর করে মৃতদেহের অভিনয় করার এইটাই তো উপযুক্ত সময়!