প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বেলজিয়ান বন্ধুর নির্দেশে পথের উপর এক জায়গায় মোটরগাড়িটা থামানো হল। ঘন উদ্ভিদের জালে আচ্ছন্ন একটা সরু পথের উপর দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল আত্তিলিওর নতুন বন্ধু তাকে অনুসরণ করলেন আত্তিলিও। লোকটি জানাল নদীর যেখানে মহিষের দল সন্ধ্যার সময়ে জলপান করতে আসে সেই জায়গাটা সে ভালোভাবেই জানে–খুব তাড়াতাড়ি চলার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে সে বলল মহিষদের আসার সময় হয়েছে, এখনই তারা এসে পড়বে।
মিনিট দশেক হাঁটার পরে সকলে এসে থামল একটা খোলা জায়গার উপর। আত্তিলিও দেখলেন প্রচণ্ড সূর্যের তাপে শুষ্ক প্রান্তরের এখানে ওখানে বর্ষার কাদা শুকিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে এবং সেই শুষ্ক কর্দমপিণ্ডগুলোর মধ্যবর্তী স্থানের মাটি ফেটে দেখা দিয়েছে অজস্র ফাটল। হাঁটার সময়ে ওই ফাটলে পা পড়লেই চিতপটাং হওয়ার সম্ভাবনা। আত্তিলিও চারপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন–ডান দিকে প্রায় সিকি মাইল দূরে রুজিজি নদী, সামনে নাতিদীর্ঘ নলখাগড়ার নিবিড় সমাবেশ আর বাঁ-দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল চোখে পড়ে উইঢিপির পর উইটিপি। ওইখানে, অসংখ্য উইঢিপির মধ্যে একটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল বেলজিয়ান, ওই জায়গাটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো। চটপট চলে যাও ওইখানে, দেরি কোরো না।
খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে কথা বলছিল বেলজিয়ান বন্ধু; তার মতোই স্বরে আত্তিলিও জানতে চাইলেন উক্ত ব্যক্তি কোথায় অবস্থান করতে চায়।
আমাকে নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না, লোকটি উত্তর দিল, কাছাকাছি থাকব। আত্তিলিও দেখলেন বেলজিয়ান তার নিজস্ব ভৃত্যকে নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ব্যাপারটা তার মোটেই ভালো লাগল না। সমস্ত জায়গাটা খুব নির্জন, অস্বস্তিকর। ফটো তোলার পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে সেই মুহূর্তে ফিরে যেতে পারলে খুশি হতেন আত্তিলিও। তাঁর সঙ্গী বন্দুকবাহক নিগ্রোটির মনোভাবও বোধ হয় সেইরকম অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে লোকটি হঠাৎ কথা কইতে শুরু করল। আত্তিলিও তার একটা কথাও বুঝতে পারলেন না। আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন ছয়টি ভাষায় তিনি লোকটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার ভাষাও লোকটির কাছে সমান দুর্বোধ্য! পর পর ছয়বার ভাষা থেকে ভাষান্তরে প্রবেশ করলেও আত্তিলিওর বক্তব্য ছিল একটি–ওহে বাপু! দয়া করে একটু চুপ করো তো! মুখের ভাষা না-বুঝলেও তার কণ্ঠস্বর আর ভাবভঙ্গি থেকে লোকটি শেষপর্যন্ত বক্তার বক্তব্য অনুধাবন করতে সমর্থ হল। সে চুপ করল।
পরে অবশ্য আত্তিলিও জানতে পেরেছিলেন ওই লোকটি তাকে একটা জরুরি সংবাদ পরিবেশন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল–দুর্ভাগ্যক্রমে তার কথা আত্তিলিও বুঝতে পারেননি, আর সেইজন্যই যথাসময়ে খবরটা শুনে সতর্ক হওয়ার সুযোগ তার হল না।
খবরটা হচ্ছে এই : বেলজিয়ানের চাকরের কাছে আত্তিলিওর বন্দুক-বাহক জানতে পেরেছিল যে, তারা নদী পার হয়ে বিপরীত তীর থেকে মহিষদের উপর গুলি চালিয়ে কয়েকটা জন্তুকে হত্যা করবে বলে ঠিক করেছে। বেলজিয়ানটির কফির আবাদ আছে; সেই আবাদে নিযুক্ত মজুরদের মাংস সরবরাহ করার জন্যই মহিষ শিকারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। মাঝখানে নদী থাকায় অপর পার্শ্বে অবস্থিত বেলজিয়ান-শিকারি ও তার ভৃত্যের অবস্থা দস্তুর মতো নিরাপদ। কিন্তু এপারে আর দুজন মানুষের পক্ষে ব্যাপারটা যে কতখানি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সে-কথা অনুমান করেই আত্তিলিওকে সাবধান করে দেবার চেষ্টা করেছিল তাঁর বন্দুকবাহক।
আত্তিলিওর পক্ষে অবশ্য নবপরিচিত বন্ধুর সদিচ্ছায় সন্দিহান হওয়া স্বাভাবিক নয়–প্রায় আড়াইশো মহিষের মাঝখানে গুলি চালিয়ে দিলে তাদের কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটা যে কারো কাছে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতো সহজ মনে হতে পারে এমন কথা আত্তিলিও সাহেবই-বা ভাববেন কেমন করে? তিনি শুধু জানতেন মহিষের দল এখনই এসে পড়বে, অতএব চটপট একটা উইঢিপির পিছনে আশ্রয় নেওয়া উচিত এই মুহূর্তে। দলটা এসে পড়লে আর নড়াচড়া করা সম্ভব হবে না, কয়েকশো বন্য মহিষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক ছিলেন আত্তিলিও। নির্দিষ্ট উইঢিপির পিছনে গিয়ে স্থান গ্রহণ করতে প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেল। আত্তিলিও তাঁর টেলিফটোর অ্যাপারেচার ঠিক করছেন নিবিষ্টচিত্তে আচম্বিতে তাঁর পায়ের তলায় গুরুগম্ভীর শব্দ তুলে মাটি কাঁপতে শুরু করল। পিছন থেকে বন্দুকবাহক নিগ্রোর অস্ফুট ভয়ার্ত স্বর আত্তিলিওর কানে এল, কিন্তু তিনি পিছনে চাইলেন না, তার দুই চোখের স্তম্ভিত দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ হয়েছে সেইদিকে যেখানে নলখাগড়ার ঝোঁপ ভেদ করে খোলা মাঠের উপর আত্মপ্রকাশ করছে মহিষের দল! আত্তিলিওর মনে হল সেই চলন্ত জান্তব স্রোতের যেন বিরাম নেই–কতগুলো মহিষ আছে ওখানে?…
ভয়ংকর এবং চমকপ্রদ দৃশ্যটাকে আরও জমকালো করে তুলেছে অস্তায়মান সূর্যের আলোকধারা–
মাথার উপর জ্বলছে রক্তরাঙা আকাশের পট, তলায় এগিয়ে চলেছে মেঘের মতো কালো এক শরীরী অরণ্য; সেই জীবন্ত ও চলন্ত অরণ্যের মাথায় মাথায় বাঁকা তলোয়ারের মতো শিংগুলোতে জ্বলে জ্বলে উঠছে রক্তলাল রবিরশ্মি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো–সঙ্গেসঙ্গে সহস্র খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন কম্পিত পৃথিবী করছে ধূলি-উদগিরণ। অপূর্ব দৃশ্য!