কিন্তু, আত্তিলিও প্রতিবাদ করেছিলেন, মহিষ দেখবে কেমন করে? অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি যেসব জানোয়ার শিং দিয়ে আঘাত করে, তারা তো চোখ বন্ধ করে আঘাত হানতে অভ্যস্ত।
বাঃ! বেশ বলেছ! বিজয়গর্বে হুংকার দিয়ে উঠল ইংরেজ-শিকারি, এতদিন আফ্রিকাতে থেকে তুমি এই কথা বললে? তাহলে কী জানলে ঘোড়ার ডিম! মহিষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাথা উঁচু রেখে শত্রুকে লক্ষ করে এই বৈশিষ্ট্যের কথা কি তোমার জানা নেই?
তাই তো! ঠিক কথা! এইবার আত্তিলিওর মনে পড়ল মহম্মদের মৃত্যুকালীন ঘটনা ঘোড়াটাকে শিং দিয়ে আঘাত করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মহিষ মাথা উঁচু করে রেখেছিল, একেবারে সামনে এসে একবারই সে মাথা নামিয়েছিল চরম আঘাত করার জন্য।
বাঃ! বেশ বলেছ! সুযোগ পেয়ে আবার বিদ্রূপ করল ইংরেজ-শিকারি, আঘাত করার পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত মহিষ তার মাথা উঁচু করে রাখে, কারণ ওই জন্তুটা হচ্ছে পয়লা নম্বরের শয়তান। সে জানে মাথা নীচু করলে খুলির উপর বসানো পাথরের মতো শক্ত হাড়ের বস তার মস্তিষ্ক ও কপালকে শত্রুর আক্রমণ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে পারে, তবু সে মাথা উঁচু করে রাখে। কেন জান? কারণ, শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত মহিষ তার শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করে অধ্যর্থ সন্ধানে আঘাত হানতে চায়। আর সেইজন্যই সে মাথা তুলে শত্রুকে দেখতে থাকে, অন্যান্য শিংওয়ালা জন্তুর মতো চোখ মুদে আক্রমণ করে না। মহিষের সামনে যদি কখনো যাও, তবে এই কথাগুলো মনে রাখবে, কখনো ভুলবে না।
ইংরেজ-শিকারির উপদেশ আত্তিলিওর মনে গেঁথে বসে গিয়েছিল। অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় অকস্মাৎ অবচেতন মনের গহন অন্তস্থল থেকে ওই কথাগুলো ভেসে এসেছিল তাঁর স্মৃতির দরজায় এবং সেইজন্যই নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন আত্তিলিও সাহেব।
কিন্তু যে আধ-পাগলা ইংরেজ সারাজীবন ধরে মহিষ-চরিত্র নিয়ে গবেষণা করে ওই জন্তু সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ হয়েছিল, সেই মানুষটা তার নিজের কথাগুলোই একদিন ভুলে গেল। একবারই ভুল করেছিল ইংরেজ-শিকারি, কিন্তু ভ্ৰম-সংশোধনের সুযোগ সে আর পায়নি। আত্তিলিওর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই একটি আহত মহিষের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ইংরেজ-শিকারি প্রাণ হারিয়েছিল।
উক্ত ইংরেজ যেখানে মারা যায়, সেই জায়গাটা হচ্ছে অ্যাংকোলে নামক নিগ্রো জাতির বাসস্থান। ইংরেজ-শিকারির আরও একটি কথার সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়েছিলেন আত্তিলিও ওই অঞ্চলেই এবং সেই প্রমাণটা যে উপস্থিত করেছিল সে শ্বেতাঙ্গ নয়–জনৈক কৃষ্ণকায় অ্যাংকোলে-শিকারি।
মানুষ যে ঠান্ডা মাথায় কতখানি সাহসের পরিচয় দিতে পারে, স্নায়ুর উপর তার সংযম যে কত প্রবল হতে পারে, তা দেখেছিলেন আত্তিলিও–ধনুর্বাণধারী এক অ্যাংকোলে শিকারির বীরত্ব তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভয়াবহ পরিস্থিতি
অ্যাংকোলে-শিকারির অদ্ভুত কৌশল ও স্নায়ুর উপর তার আশ্চর্য সংযম দেখে ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠেছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু কতখানি মানসিক শক্তি থাকলে মানুষ নির্বিকারভাবে ওই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে সে-বিষয়ে তাঁর ধারণা সেদিন খুব স্পষ্ট ছিল না।
দু-বছর পরে তিনি নিজে যখন ওই অবস্থায় পড়লেন, তখনই বুঝতে পারলেন কী অসাধারণ মানসিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল পূর্বোক্ত ক্ষুদ্রকায় নিগ্রো শিকারি।
খুব ভেবে দেখলে অবশ্য বলতে হয় আত্তিলিওর অবস্থা ওই নিগ্রো শিকারির চাইতেও খারাপ ছিল–অ্যাংকোল-শিকারি স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল এবং ওইরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তার পেশাগত শিক্ষা আর সুদীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির ইতিহাসও ধর্তব্য কিন্তু আত্তিলিও সাহেব কোনোদিনই বন্য মহিষের মতো বদখত জানোয়ারের সম্মুখীন হওয়ার অভিলাষ পোষণ করেননি, ঘটনাচক্রের শিকার হয়েই এক অভাবনীয় বিপদের সামনে রুখে দাঁড়াতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।
যখনকার কথা বলছি সেই সময়ে আত্তিলিও গত্তি আফ্রিকার কিভু হ্রদের তীরবর্তী সাময়িক আস্তানা থেকে চিবিন্দা নামক স্থানের অরণ্যে অভিযান চালানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তাঁর অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল দানব-গরিলা। ওই জীবটির সম্বন্ধে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
দৈবক্রমে একদিন আত্তিলিওর সঙ্গে একজন বেলজিয়ামের অধিবাসীর পরিচয় হয়ে গেল। ওই লোকটি জানাল কিভু হ্রদ আর টাঙ্গানিকা হ্রদের মধ্যবর্তী প্রান্তরে তার সঙ্গে গেলে একদল মহিষের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবেন আত্তিলিও সাহেব। গরিলা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে সেই সময় মাথা ঘামাচ্ছিলেন না আত্তিলিও, কিন্তু লোকটি বলল আড়াইশো মহিষ নিয়ে গঠিত ওই প্রকাণ্ড দলটার ফটো তোলার কাজ চিড়িয়াখানাতে ফটো নেওয়ার মতোই সহজ হবে। এত সহজে আড়াইশো মহিষের একটা প্রকাণ্ড দলকে তার ক্যামেরাতে বন্দি করা যাবে শুনে রাজি হয়ে গেলেন আত্তিলিও।
তুমি একটা উইয়ের ঢিপি বেছে নেবে, লোকটি বলল, ওই ঢিপির পিছন থেকে ফটো তুলবে যত খুশি। এমন সুযোগ আর কখনো পাবে না।
বেলজিয়ানের কথায় খুব নিশ্চিন্ত হয়ে আত্তিলিও গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হলেন। ব্যাপারটা মোটেই বিপজ্জনক নয়, চিড়িয়াখানাতে যাওয়ার মতোই সোজা–অতএব শিকারে যাওয়ার উপযুক্ত বুট পরার প্রয়োজন মনে করেননি আত্তিলিও; শহর-অঞ্চলে যে সাধারণ জুতো পরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন সেই জুতো জোড়া পায়ে চড়িয়ে তিনি চললেন মহিষযুথের আলোকচিত্র সংগ্রহ করতে রাইফেলটা তিনি নিয়েছিলেন নিতান্ত অভ্যাস বশে। তাঁবুর লোকজন দরকারি কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই বাছাবাছি না-করে যে-নিগ্রোটিকে সামনে পেলেন তাকেই তিনি ডেকে নিলেন রাইফেলটা বহন করার জন্য। আত্তিলিও দুটো হাতই খালি রাখতে চেয়েছিলেন–লম্বা লেন্স আর ক্যামেরা ভালোভাবে ব্যবহার করতে হলে দুই হাতই খালি রাখা দরকার। সবচেয়ে ভালো ক্যামেরাটাকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন আত্তিলিও…