আফ্রিকাবাসী মহিষদের মধ্যে কেপ-বাফেলো নামক জন্তুটি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে, কিন্তু আরও দুই জাতের মহিষ আফ্রিকাতে দেখা যায়। গ্যামা নামে একরকম মহিষজাতীয় জানোয়ার আরব দেশে চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া আছে বনগোরু বা পিগমি বাফেলো। কেপ-বাফেলোর কাধ মাটি থেকে পাঁচ ফিট কিংবা আর একটু বেশি উঁচু হয়, কিন্তু পিগমি বাফেলোর কাঁধের উচ্চতা মাটি থেকে মাত্র তিন ফিট; তার শিং ধারালো, তবে ছোটো এবং দেহের রং তার অতিকায় জ্ঞাতি ভাইয়ের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়–রক্তাভ-পীত বর্ণে রঞ্জিত ঘন রোমশ দেহ নিয়ে একা অথবা জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে ওই খর্বকায় মহিষ। কেপ-বাফেলোর মতো দলবদ্ধ হয়ে পিগমি বাফেলো বা বনগোর কখনো বাস করে না।
আকারে ছোটো হলেও ওই মহিষগুলো যে কতখানি শক্তি সাহস ও ক্ষিপ্রতার অধিকারী হয়, নিম্নলিখিত ঘটনা থেকেই তা বোঝা যাবে।
বেলজিয়ান কঙ্গোর জঙ্গলে আত্তিলিও সাহেব একবার একটা ওকাপিকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরার চেষ্টা করেন। ওকাপি হচ্ছে নিরামিষভোজী দুষ্প্রাপ্য পশু। একটা ওকাপিকে জীবন্ত অবস্থায় ধরার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছিলেন আত্তিলিও হঠাৎ একদিন সৌভাগ্যক্রমে মাম্বুটি পিগমি জাতির নিগ্রো পথপ্রদর্শকরা একটা ওকাপিকে ঘেরাও করে ফেলল। ওকাপির পদচিহ্নের কাছাকাছি বনগোরু বা খর্বকায় মহিষের টাটকা পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন আত্তিলিও। কিন্তু ওকাপির জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিলেন বলে তাড়াহুড়োর মধ্যে তিনি পিগমিদের কাছে খর্বকায় মহিষ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করেননি।
খুব মনোযোগের সঙ্গে ওকাপিকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলল। একটা বৃহৎ আকার নিয়ে গোল হয়ে অবস্থান করছিল সবাই, মাঝখানে ওকাপিকে লক্ষ করে সেই চলন্ত মনুষ্যবৃত্তের পরিধি ক্রমশ ছোটো হয়ে আসতে লাগল… আচম্বিতে সবুজ উদ্ভিদের জাল ভেদ করে দুটি রক্তাভ বিদ্যুঝলকের প্রচণ্ড আবির্ভাব! কী হচ্ছে-না-হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই দারুণ সংঘাতে ওকাপি-শিকারিরা চতুর্দিকে ছিটকে পড়তে লাগল, আত্তিলিওর মাথা থেকে উড়ে গেল হেলমেট আর হাত থেকে বেরিয়ে গেল রাইফেল এক মুহূর্তের জন্য আত্তিলিও অনুভর করলেন তাঁর পায়ের তলা থেকে সরে গেছে মাটি এবং দেহ হয়েছে শূন্যপথে উড্ডীয়মান–পরক্ষণেই মৃত্তিকার কঠিন স্পর্শ আর চোখের সামনে সর্ষেফুল!
হইচই, চিৎকার, ধুন্ধুমার–যাচ্ছেতাই ব্যাপার!
দুটো বেঁটে বেঁটে মহিষ ধাঁ করে মানুষের ব্যুহ ভেদ করে বিদ্যুৎঝলকের মতো অন্তর্ধান করল। সেইসঙ্গে পালিয়ে গেল আত্তিলিও সাহেবের এত সাধের ওকাপি!
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মূল্যবান উপদেশ
খর্বকায় বামন মহিষের ধাক্কা খেয়ে নাস্তানুবুদ হওয়ার কয়েকদিন পরেই এক ইংরেজ-শিকারির সঙ্গে হঠাৎ আত্তিলিওর আলাপ হয়ে গেল। ওই ইংরেজ শিকারিটি সারাজীবন ধরে আফ্রিকাতে বন্য মহিষের গতিবিধি লক্ষ করেছে, বহু মহিষ শিকার করেছে এবং তার ফলে মহিষ-চরিত্র সম্বন্ধে সে হয়ে উঠেছে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ। ইরামা নামক স্থানে একটি দোকান থেকে শ্বেতাঙ্গরা জিনিসপত্র কিনতেন–আমাদের আত্তিলিও সাহেবও একদিন ওই দোকানে উপস্থিত হলেন কয়েকটা প্রয়োজনীয় বস্তু ক্রয় করার জন্য। পূর্বে উল্লেখিত ইংরেজ-শিকারিও একই উদ্দেশ্যে সেই সময়ে দোকানে উপস্থিত হয়েছিল।
তছোটো বুশ ব্লাউজ ও শর্ট পরিহিত আত্তিলিওর অনাবৃত বাহু ও পায়ের বিভিন্ন স্থানে আঘাতজনিত কালশিরার চিহ্ন দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠল দোকানদার। তাকে সংক্ষেপে ওকাপি ও খর্বকায় মহিষ-ঘটিত দুর্ঘটনার কথা বলে প্রসঙ্গ শেষ করে দিলেন আত্তিলিও, তারপর টিনে বন্ধ শুষ্ক আনাজ ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু মহিষ শব্দটি কানে যাওয়ামাত্র আগন্তুক ইংরেজ আত্তিলিওর দিকে ছুটে এল।
লোকটির কথাবার্তায় তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চিহ্ন দেখে আত্তিলিও বুঝলেন সে তাঁকে নিতান্তই তৃতীয় শ্রেণির শিকারি মনে করছে। তিনি গরম হয়ে উঠলেন এবং শিকারি-জীবনের কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, আত্তিলিও গত্তি নিতান্ত সাধারণ মানুষ নয়। লোকটি তখন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং আবিষ্কৃত তথ্য নিয়ে কথা কইতে শুরু করল। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আত্তিলিও যখন তার সান্নিধ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হলেন, তখন মূল্যবান সময়ের অপচয় হওয়ার জন্য তিনি মনে মনে বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কয়েক বছর পরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্তিলিও উপলব্ধি করেছিলেন ইরামার এক অখ্যাত দোকানে দাঁড়িয়ে অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ-শিকারির কাছ থেকে মহিষ-চরিত্র সম্পর্কে কিছু জ্ঞানলাভ করেছিলেন বলেই তিনি সময়কালে কর্তব্য স্থির করে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
মহিষ-প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলেছিল ওই ইংরেজ-শিকারি। সুদীর্ঘ শিকারি-জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে সে জানতে পেরেছিল আক্রমণ-উদ্যত ক্ষিপ্ত মহিষকে বাধা দিতে পারে প্রশস্ত নদী, আগুনের জ্বলন্ত প্রতিবন্ধক এবং–
এবং মানুষের মৃতদেহ!
কথাটা শুনতে খুবই অদ্ভুত বটে, কিন্তু ইংরেজ-শিকারি দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল, মৃতদেহের উপর মহিষ কখনো আক্রমণ চালায় না–সে মৃতদেহ লক্ষ করে ছুটে আসবে, কিন্তু সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়বে কিছুতেই মরা মানুষকে স্পর্শ করবে না। দূরে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার তেড়ে এসে থমকে দাঁড়াবে–এমনি করে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর এক সময়ে প্রস্থান করবে মহিষ। আত্তিলিওর হঠাৎ-পাওয়া নতুন বন্ধু বলেছিল, যে মুহূর্তে মহিষ দেখবে মানুষটা নড়াচড়া না-করে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে, সেই মুহূর্তেই সে ধরে নেবে ওটা মৃতদেহ আর তৎক্ষণাৎ সে থেমে যাবে।