বলতে বলতেই সে তড়াক করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসেছে, আর হতভম্ব আত্তিলিওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তিরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে!
হঠাৎ আত্তিলিওর মনে হল মহম্মদ আলিও বোধ হয় অন্যান্য অনুচরদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছে। নিখুঁত আরবীয় পদ্ধতিতে ফাঁকি দেওয়ার এইটাই বোধ হয় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও আধুনিক কায়দা। আত্তিলিও সাহেবের সন্দেহ সত্য, না, অন্যায়ভাবে মহম্মদের বীরত্ব ও সদিচ্ছার প্রতি সন্দিহান হয়ে তিনি উক্ত আরব দেশীয় মানুষটির প্রতি অবিচার করেছিলেন–সে-কথা কোনোদিনই জানা সম্ভব হবে না। কারণ, এতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনার স্রোত একটা প্রহসনমূলক নাটকের সূচনা করছিল–আচম্বিতে ঘটনাচক্রের দ্রুত পরিবর্তন সেই প্রহসনকে রূপান্তরিত করল এক বিয়োগান্ত নাটকের রক্তাক্ত দৃশ্যে।
এই ভয়ংকর পরিবর্তনের জন্য দায়ী হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড বন্য মহিষ। যে-দলটাকে আত্তিলিও অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন, এই জন্তুটা সেই দলভুক্ত নয়–একটা দলছাড়া মহিষের একক উপস্থিতি সমস্ত ঘটনাস্রোতকে বদলে দিয়েছিল।
মহম্মদ তখনও ঘোড়ার পিঠে দৃশ্যমান, আত্তিলিও প্রাণপণে চেঁচিয়ে তাকে ফিরে আসতে বলছেন–হঠাৎ ঝোঁপজঙ্গল ভেদ করে আত্তিলিওর থেকে প্রায় তিনশো ফিট দূরে আবির্ভূত হল এক কৃষ্ণকায় বিপুলবপু বন্য মহিষ! জন্তুটা ঝড়ের বেগে ধেয়ে এল মহম্মদ আলির বাহন আরবি ঘোড়াটার দিকে!
সাবধান! চেয়ে দেখো–সামনে বিপদ! চেঁচিয়ে মহম্মদকে সাবধান করে দিলেন আত্তিলিও, পরক্ষণেই ছুটলেন তাবুর ভিতর থেকে রাইফেল হস্তগত করার জন্য।
মুহূর্তের মধ্যেই রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলেন আত্তিলিও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে প্রচণ্ড সংঘর্ষে মিলিত হল মানুষ ও ঘোটক! আত্তিলিও সচমকে দেখলেন মহিষের একটা শিং ঘোড়ার বুকের ভিতর ঢুকে গেছে! পরক্ষণেই দেখা গেল ঘোড়াটাকে শিং বিধিয়ে শূন্যে তুলে ফেলেছে। মহিষ এবং দারুণ যাতনায় মহিষের মাথার উপর ঘোড়া করছে ছটফট!
মহম্মদ আলি ছিটকে পড়েছিল কয়েক গজ দূরে, ছুটে পালানোর জন্য সে তাড়াতাড়ি ভূমিশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করল কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই মহিষ তাকে লক্ষ করে ছুটে এল! ঘোড়াটা তখনও মহিষের মাথার উপর শৃঙ্গাঘাতে বিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছিল, কিন্তু ঘোটকের দেহভার মহিষাসুরের গতিরোধ করতে পারল না–সে এসে পড়ল ভূপতিত মহম্মদ আলির দেহের উপর!
ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন আত্তিলিও; অভ্যস্ত আঙুলের স্পর্শে রাইফেলের বুলেট সশব্দে মহিষের হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। আত্তিলিও দৌড়ে এলেন মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ জন্তু দুটির দিকে। ঘোড়াটা তখনও অসহ্য যাতনায় ছটফট করছিল। আত্তিলিওর রাইফেল তার মৃত্যুকে সহজ করে দিল। মহিষের দেহে প্রাণ ছিল না, গুলি লাগার সঙ্গেসঙ্গেই সে মারা গেছে।
মহম্মদের অবস্থা খুবই শোচনীয় মহিষ আর ঘোড়া জড়াজড়ি করে তার উপরই পড়েছে, দুটি বিশাল দেহের নীচে পিষ্ট হয়ে সে এখন মৃত্যুপথের যাত্রী।শিং দুটো মস্ত বড়ো, প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বলে উঠল মহম্মদ, যেমন… যেমন… আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম. তার কণ্ঠ রুদ্ধ হল, কালো গোঁফ দুটির নীচে রক্তমাখা দাড়ির ভিতর থেকে যে-হাসিটি ফুটে উঠেছিল, সেই হাসির রেখা হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মৃত্যুর স্পর্শে–হাসতে হাসতেই মৃত্যুবরণ করল মহম্মদ আলি।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মহিষ
পূর্বোক্ত ঘটনার পর থেকেই মহিষ সম্বন্ধে তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ পোষণ করতেন আত্তিলিও গত্তি।
একাধিক পুস্তকে মহিষ-বিষয়ক তথ্য পাঠ করে আত্তিলিও জেনেছিলেন ওই জন্তুটি আক্রান্ত না হলে অথবা প্ররোচিত হলে বিনা কারণে কখনো মানুষকে আক্রমণ করে না। কিন্তু মহম্মদ আলি ও তার বাহন আরবি ঘোড়াটার মৃত্যু দেখে আত্তিলিও বুঝেছিলেন কেতাবে লিখিত তথ্য আংশিক সত্য হলেও হতে পারে, সর্বাংশে সত্য কখনোই নয়। এইখানে আফ্রিকার মহিষ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা দরকার। মহিষগোষ্ঠীর কোনো জন্তুকেই নিরীহ বলা চলে না, মহিষ মাত্রেই ভয়ংকর জীব। গৃহপালিত মহিষও উত্তেজিত হয়ে মানুষের প্রাণবিপন্ন করেছে এমন ঘটনা বিরল নয়। মহিষগোষ্ঠীর বিভিন্ন জন্তুর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জীব আফ্রিকার কেপ-বাফেলো। লেপার্ড, হায়না প্রভৃতি মাংসাশী জানোয়ার কখনো কেপ-বাফেলোর ধারেকাছে আসে না। স্বয়ং পশুরাজও পূর্ণবয়স্ক কেপ-বাফেলোর সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় অনিচ্ছুক ক্রোধে আত্মহারা না হলে সিংহ কখনো মহিষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। রুদ্রমূর্তি মহিষকে দেখে সিংহ চম্পট দিয়েছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। মহিষ-পরিবারের সকল পশুরই প্রধান অস্ত্র শিং আর খুর–কেপ-বাফেলো নামক আফ্রিকার অতিকায় মহিষও ওই দুটি মহাস্ত্রে বঞ্চিত নয়; উপরন্তু তাদের মাথার উপর থাকে পুরু হাড়ের দুর্ভেদ্য আবরণ–শিরস্ত্রাণের মত মাথার উপর ওই কঠিন অস্থি-আবরণ ভেদ করে শ্বাপদের নখদন্ত কিংবা রাইফেলের বুলেট মহিষের মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে না। ওই অস্থি-আবরণের ইংরেজি নাম বস অব দি হর্নস; সংক্ষেপে বস। বস-এর দু-দিকে অবস্থিত শিং-এর দৈর্ঘ্য সাধারণত ৩৬ ইঞ্চি থেকে ৪৫ ইঞ্চি, তবে ৫৬ ইঞ্চি লম্বা শিংও দেখা গেছে। পূর্বোক্ত মহিষের আয়ু তিরিশ বছর, কিংবা আর একটু বেশি। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত অধিকতর বলশালী তরুণ মহিষদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে অনেক সময় প্রাচীন মহিষরা দল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দলছাড়া মহিষ নিঃসঙ্গ অবস্থায় বিচরণ করে এবং সমগ্র পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী সম্বন্ধে প্রচণ্ড বিদ্বেষ পোষণ করে। নিঃসঙ্গ পুরুষ মহিষই সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার। মহম্মদকে হত্যা করেছিল ওইরকম একটি নিঃসঙ্গ ভয়ংকর গুন্ডা মহিষ।