একে অল্প বয়সের গরম রক্ত, তার উপর বিস্তর বই-টই পড়ে আত্তিলিও হয়ে পড়েছেন সবজান্তা–অতএব সকলের মতামত অগ্রাহ্য করে তিনি উপস্থিত হলেন সুদানের খার্তুম নামক স্থানে। শুধু গন্তব্যস্থল সম্পর্কে পরিচিত মানুষের মতামত উপেক্ষা করেই ক্ষান্ত হননি আত্তিলিও, সকলের সাবধানবাণী তুচ্ছ করে তিনি মেলামেশা শুরু করলেন মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে। আত্তিলিওর শুভার্থীরা তাঁকে একবাক্যে ওই বিপজ্জনক লোকটির সংশ্রবে আসতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু স্বজান্তা আত্তিলিও কারো কথায় কান দিলেন না। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল মহম্মদ আলি এবং আত্তিলিও গত্তির সম্পর্ক হচ্ছে কায়ার সঙ্গে ছায়ার মতোই অবিচ্ছিন্ন, উপযুক্ত দুটি মানুষকে সর্বত্রই দেখা যায় একসঙ্গে।
খার্তুমের মানুষ মহম্মদ আলিকে ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদী বলেই মনে করত। তাদের ধারণা হচ্ছে উক্ত ব্যক্তি খার্তুম ছেড়ে কোথাও যায়নি, এবং সুদানের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যদি কেউ তার কাছে কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করতে যায় তবে সেই নির্বোধ তিব্বতের লামার বিষয়েও মহম্মদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করতে পারে–কারণ, মহম্মদ আলির কাছে সুদানের বন্যপ্রাণী আর তিব্বতের লামা দুই-ই সমান। দুটি বিষয়েই সে সমান অজ্ঞ।
আত্তিলিও কিন্তু স্থানীয় মানুষের কথা বিশ্বাস করেননি। তাঁর মতে মহম্মদ বাঁচাল বটে, কিন্তু মিথ্যাবাদী নয়। মহম্মদের মুখে যেসব ভয়ানক ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, সেইসব ঘটনা যে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ না হয়ে ধাপ্পাবাজ মিথ্যাবাদীর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনাশক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এমন কথা আত্তিলিওর মনে আসেনি–মহম্মদ সম্পর্কে জনসাধারণের অভিমত ঈর্ষাকাতর মানুষের নিন্দা বলেই মনে করেছিলেন আত্তিলিও। সুতরাং আত্তিলিওর বিচারে শিকার-অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হল যে ব্যক্তি, তার নাম মহম্মদ আলি।
সমগ্র খার্তুমের মানুষ একদিন বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে দেখল, আত্তিলিও সাহেব মহম্মদ আলিকে তার পথপ্রদর্শকের কার্যে নিযুক্ত করেছেন। আত্তিলিও পরে জানতে পেরেছিলেন, কথার জাল বুনে চতুর মহম্মদ তাকে যে পারিশ্রমিক অর্থ দিতে রাজি করিয়েছিল, সেই টাকার অঙ্কটা ছিল যথেষ্টর চাইতেও বেশি। অবশ্য মহম্মদের পক্ষে পারিশ্রমিক অর্থ শেষ পর্যন্ত হস্তগত করা সম্ভব হয়নি।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মহম্মদ আলির মৃত্যু
ছয়জন স্থানীয় অধিবাসী নিয়ে গঠিত ছোটো দলটিকে নিয়ে ফাংপ্রভিন্স নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন আত্তিলিও। তিনি এবং মহম্মদ আলি ঘোড়ায় চড়ে দলের আগে আগে চলছিলেন। নির্দিষ্ট স্থানে এসে এক ব্যক্তির মুখে আত্তিলিও শুনলেন ওই অঞ্চলের সবচেয়ে আশ্চর্য দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে আটশো মহিষের একটি বিরাট দল। এমন প্রকাণ্ড দল বড়ো একটা দেখা যায় না। পূর্বোক্ত মহিষযূথকে স্বচক্ষে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করেছে মাত্র কয়েকটি লোক। তারা সকলেই একবাক্যে জানিয়েছে এমন চমকপ্রদ ও ভয়াবহ দৃশ্য কখনো তাদের চোখে পড়েনি। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন আত্তিলিও–শত শত অতিকায় মহিষ প্রায় এক মাইল স্থান ধরে সারিবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করেই তাঁর সর্বাঙ্গ হয়ে উঠল রোমাঞ্চিত! তিনি ঠিক করলেন যেভাবেই হোক ওই মহিষযূথকে তিনি একবার স্বচক্ষে দর্শন করবেন।
তাঁবুতে ফিরে তিনি লোকজনদের জানিয়ে দিলেন উল্লিখিত মহিষযুথের উদ্দেশে তিনি শীঘ্রই যাত্রা করবেন বলে মনস্থ করেছেন এবং ওই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যেকোনো বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে তিনি প্রস্তুত।
আত্তিলিওর ঘোষণা শেষ হতে-না-হতেই মোটবাহক, রাঁধুনি, ছোকরা-চাকর প্রভৃতি যে ছয়জন লোক দলে ছিল তারা সকলেই প্রাণপণে কণ্ঠস্বরের প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল! সেই তুমুল কোলাহলের মধ্যে তাদের বক্তব্য কিছুই বুঝতে পারলেন না আত্তিলিও। তিনি স্বয়ং এইবার চেঁচাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ তারস্বরে চেঁচিয়ে আত্তিলিও দলের মধ্যে স্তব্ধতার সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। তারপর তিনি মহম্মদ আলিকে ডেকে দলের লোকদের এমন অসংগত আচরণের কারণ জানতে চাইলেন।
মহম্মদ আত্তিলিওকে জানাল তার পরিকল্পনা শুনে উৎসাহিত হয়েই দলের মানুষ হঠাৎ কোলাহল করে উঠেছিল, অতএব ওই নিয়ে আত্তিলিওর আর চিন্তা করা উচিত নয়।
না, আত্তিলিও আর চিন্তা করেননি সেদিন এবং পরের দিন যখন তারা রওনা হলেন, তখনও দলের লোকদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর নিয়ে মাথা ঘামাননি আত্তিলিও–কিন্তু তিনদিন পরে এক মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতে উঠেই যখন তিনি আবিষ্কার করলেন মহম্মদ ছাড়া প্রত্যেকটি লোকই হঠাৎ তাবু থেকে অদৃশ্য হয়েছে, তখনই কয়েকদিন আগে কণ্ঠস্বরের তীব্র প্রতিযোগিতার কথা তার মনে হল এবং মহম্মদ আলি যে দলের লোকের উৎকণ্ঠার বিপরীত ব্যাখ্যা করে মনিবকে ধোঁকা দিয়েছে এ-বিষয়ে তার সন্দেহ রইল না একটুও।
মহম্মদকে ডাকলেন আত্তিলিও। দলের যাবতীয় মানুষ তাঁবু ছেড়ে উধাও হয়েছে এই খবর পাওয়ামাত্র যেন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল মহম্মদ আলি। তৎক্ষণাৎ ঘোড়া সাজিয়ে সে জানাল, সবচেয়ে বড়ো মহিষের মাথাটা আত্তিলিওকে যোগাড় করে দেবে বলে যে প্রতিজ্ঞা সে করেছিল, সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে সে দৃঢ়সংকল্প হতচ্ছাড়া পলাতকদের সে বুঝিয়ে দেবে মহম্মদ আলি কোন ধরনের মানুষ, কারো সাহায্য ছাড়াই মহিষযুথের সংবাদ সে সংগ্রহ করতে সক্ষম এবং ওই খবর আনার জন্য এক মুহূর্ত দেরি না-করে এখনই সে যাত্রা করতে প্রস্তুত।