পরের দিন সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের ভিতর দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন অভিযাত্রীরা। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, যে লোকগুলো একদিন আগে বৃষ্টির জন্য নরহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তারাই আজ হাঁটু পর্যন্ত কাদাজলের ভিতর মালপত্র ঘাড়ে নিয়ে বিব্রত! বৃষ্টিপাতের অবস্থা দেখে অভিযাত্রীরা বুঝলেন বৃষ্টি এখন সহজে থামছে না, অন্তত বেশ কিছুদিন ধরে চলবে অনর্গল ধারাবর্ষণ। হঠাৎ জুলুল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় পূর্ব-পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আত্তিলিও সাহেব জিপোসোর কাছে প্রকৃত মনোভাব ব্যক্ত করেননি। যাওয়ার আগে অশ্রুসজল অভিযাত্রীদের বিদায় জানাল জামানি।
জুলু-যোদ্ধারা খুব মনমরা হয়েই অভিযাত্রীদের মোট বহন করার কার্যে নিযুক্ত হয়েছিল, ভালো ভালো হাতে-গড়া কারুশিল্পও তারা অভিযাত্রীদের উপহার দিতে বাধ্য হয়েছিল জিপোসোর আদেশে অতএব তাদের মুখে-চোখে যে খুব আনন্দের চিহ্ন ফুটে ওঠেনি সে-কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে তাদের মুখে হাসি ফুটল–আত্তিলিও সাহেব উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে কুণ্ঠিত হননি, এমনকী উপহারের বিনিময়েও অর্থ দিয়েছিলেন মুক্তহস্তে।
জুলুদের বিদায় করে অভিযাত্রীরা এইবার নিজেদের মধ্যে আলোচনাসভা ডাকলেন। হঠাৎ জুলুল্যান্ড থেকে বিদায় নেওয়ায় তাঁদের কর্মসূচির পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছিল। আলোচনার ফলে স্থির হল, মোজাম্বিক এবং দক্ষিণ রোডেশিয়ার ভিতর দিয়ে যাবেন বিল ও প্রফেসর। কোনো অজ্ঞাত কারণে হাতি শিকারের জন্য অস্বাভাবিক আগ্রহ প্রকাশ করছিল বিল; কয়েকটা হাতির ভবলীলা সাঙ্গ করতে না-পারলে তার স্বস্তি নেই। অতএব ঠিক হল, বায়রা থেকে ইউরোপ হয়ে যাত্রা করার আগে প্রফেসরের সঙ্গে আত্তিলিও দেখা করবেন।
তারা স্থির করলেন কেপটাউন থেকে ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকাতে গিয়ে নতুন করে একটা অভিযানবাহিনী সংগঠিত করবেন এবং আফ্রিকার যেসব স্থান আজও অনাবিষ্কৃত সেখানে পূর্বোক্ত অভিযানবাহিনীর সাহায্যে গবেষণার কাজ চালাবেন।
পরবর্তী অভিযানের জন্য যে-জায়গাটা আত্তিলিও মনোনীত করেছিলেন, সেটি হল আফ্রিকার কিভু অরণ্য–অতিকায় দানব-গরিলার বাসস্থান।
অভিযাত্রীদের জল্পনাকল্পনা শুনে অদৃশ্য নিয়তির ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটেছিল মনে হয়; কারণ–
বায়রা থেকে জাহাজ ধরতে পারেনি বিল, তার আগে সে নিজেই ধরা পড়ে গেল এক স্বর্ণকেশী সুন্দরীর হাতে। কিন্তু তারপরই নববধূর সান্নিধ্য ত্যাগ করে বিল ছুটে গেল এক সাংঘাতিক ভবিতব্যের দিকে–
এইবার প্রফেসরের কথা। কেপটাউনে বন্ধুবর আত্তিলিওর সঙ্গে দেখা করার পরিবর্তে তিনি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন এবং আমাদের কাহিনি থেকেও বিদায় গ্রহণ করলেন এখান থেকেই আত্তিলিও গত্তির অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির মধ্যে আমরা আর প্রফেসরকে দেখতে পাব না…।
এদিকে কাহিনির নায়ক আত্তিলিও কিভুর জঙ্গলে দানব-গরিলার সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু গরিলার পরিবর্তে তার সম্মুখে আবির্ভূত হল দলবদ্ধ এক জান্তব বিভীষিকা! সেই চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ নিয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে আত্তিলিওর পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি।
অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৭৯
৩. শত্রু – প্রথম খণ্ড
সৈনিকের তৃতীয় অভিজ্ঞতা
শত্রু – প্রথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – আত্তিলিওর সঙ্গী
বর্তমান কাহিনিতে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার আগে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি বলেছেন, এই ঘটনা যদিও বহুদিন আগে ঘটেছে, তবু এখনও মহিষ শব্দটি যদি তিনি শোনেন অথবা উক্ত পশু সম্বন্ধে কোনো আলোচনা যদি তাঁর শ্রুতিগোচর হয়, তাহলে তাঁর সর্বাঙ্গের মাংসপেশি হয়ে যায় আড়ষ্ট–এখনও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে তিনি যেন শুনতে পান শত শত খুরের ভয়াবহ ধ্বনি, এখনও তার মানসপটে ভেসে ওঠে সেই ভয়ংকর দৃশ্য যেখানে প্রান্তরের উপর দণ্ডায়মান তার অসহায় দেহ লক্ষ করে ছুটে আসছে শত শত জীবন্ত বিভীষিকা, সম্মুখে অবস্থিত মনুষ্যমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করে মাটিতে মিশিয়ে দেবার জন্য…
এই ভীতিপ্রদ কাহিনি পরিবেশন করার আগে আফ্রিকার বুকে আত্তিলিওর প্রথম অভিজ্ঞতার বিবরণী পাঠকের দৃষ্টিগোচর হওয়া দরকার–ওই বিবরণ পাঠ করলেও পাঠক বুঝতে পারবেন আফ্রিকাবাসী বিভিন্ন জীবজন্তুর মধ্যে কেবল মহিষ নামক জীবটি সম্বন্ধে আত্তিলিওর বিদ্বেষমূলক মনোভাব নিতান্ত অকারণে সৃষ্ট হয়নি। কমান্ডার সাহেব তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, আফ্রিকাবাসী যাবতীয় মহিষকেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে শত্রু বলে মনে করেন। আফ্রিকার অরণ্যে পদার্পণ করার সঙ্গেসঙ্গেই মহিষ সম্বন্ধে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন আত্তিলিও। যে শোচনীয় ঘটনার ফলে পূর্বোক্ত শৃঙ্গধারী পশুটি সম্পর্কে আত্তিলিওর মনে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হয়েছিল, সেই ঘটনার বিশদ বিবরণীর মধ্যে বর্তমান কাহিনির শুরু।
আত্তিলিও গত্তির বয়স যখন কুড়ির কিছু বেশি, সেই সময়ে শিকার-কাহিনি, অভিযান-কাহিনি ও জীবজন্তু বিষয়ক প্রচুর পুস্তক পাঠ করে তার ধারণা হল ওইসব ব্যাপারে তার জ্ঞান সম্পূর্ণ। হয়েছে–এইবার একটা অভিযানে বেরিয়ে পড়লেই হয়। তিনি মনে করলেন কয়েকটা ঘোড়া, রাইফেল আর গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলেই আফ্রিকার দুর্গম অরণ্যে অভিযান শুরু করা যায়। অ্যাংলো ইজিপশিয়ান সুদানের অজ্ঞাত স্থানগুলোকেই অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছিলেন আত্তিলিও সাহেব। পরে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন পুথিগত বিদ্যা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মূল্য এক নয়।