তবে টোয়াবেনির অন্যতম কন্যা মদাবুলি সম্বন্ধে আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠকের কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক কারণ, উল্লিখিত জুলুবালিকা হচ্ছে এই অরণ্য-নাটকের নায়িকা।
জিপোসো মন্দাবুলির সঙ্গে গোর বিবাহের ব্যবস্থা করল। তবে টোয়াবেনির পরিবর্তে যেহেতু এখন কন্যার অভিভাবকের স্থান নিয়েছে জিপোসো, তাই বরকে পূর্ব-প্রতিশ্রুত তিরিশটি গোরু কন্যাপণ দিতে হবে জিপোসোরই শ্রীহস্তে! বিচারের এই অংশটুকু শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায় রাজ্যের সর্বত্র কী ঘটেছিল সে নিয়ে সর্বাধিনায়ক সর্বদাই অবহিত না হলে গোর কন্যাপণের প্রতিশ্রুতি জিপেসোর কর্ণগোচর হয় কী করে?…
আত্তিলিওর জুলু অনুচর জামানিকে নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে? জিপোসোর বিচারসভাতে জামানিকেও ডাকা হয়েছিল। সে আত্তিলিওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিল বলেই একটা দুর্ঘটনা গতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু জুলু জাতির অধিনায়কের পক্ষে সমস্ত ব্যাপারটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে খুব অন্যায় হয় না বরং জাতীয় স্বার্থে সেটাই স্বাভাবিক।
অবশ্য জিপোসো একবারও বলেনি যে, জামানি মূখের মতো জুলুজাতির গোপন তথ্য সাদা মানুষের কাছে ফাস করে দিয়েছে, এবং যে-মানুষ বিদেশিদের কাছে এতখানি বিশ্বস্ত হতে পারে, দেশের বাইরে তার উপস্থিতি জাতির পক্ষে বিপজ্জনক। না, না, এসব কথা মোটেই বলেনি জিপোসো, বরং জামানির প্রশংসায় সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। জিপোসো জানাল তার দেশের যে-মানুষটি এমন অদ্ভুত জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারী তাকে সে হারাতে পারে না। জাতীয় স্বার্থে ওই লোকটির সর্বদাই অবস্থান করা উচিত দেশের মধ্যে। অতএব সর্বধিনায়কের নিজস্ব পরামর্শদাতার সম্মানজনক পদে জামানিকে বহাল করা হল এবং টোয়াবেনির ক্রাল-এর যাবতীয় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ও ভোগ করার অধিকার দেওয়া হল জামানিকেই।
জামানিকে শুধু ঘরই দেয়নি জিপোসো, ঘরনির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। দুটি জুলু যুবতীর সঙ্গে জামানির বিবাহের ব্যবস্থা করে দিল সর্বাধিনায়ক জিপোসো। দু-দুটো বউ পেয়ে জামানি এত খুশি হল যে, কন্যাপণ হিসাবে জিপোসোকে এক কুড়ি গোরু দিতেও আর আপত্তি হল না। আত্তিলিও বুঝলেন, জিপোসো সকলের প্রতি সুবিচার করল বটে সেইসঙ্গে নিজের সম্পত্তির পরিমাণও বাড়িয়ে ফেলল সুকৌশলে!
সকলেরই যখন বিচার হল, তখন আত্তিলিওর দলবলই-বা বাদ যায় কেন? জিপোসোর পরিবর্তে অন্য কোনো নেতা হলে সে স্পষ্টই বলত, শোনো ভাই! তোমরা এখানে এসে সিংহ মেরেছ, দাঁতের ব্যথা সারিয়েছ। ভালো ভালো উপহারও দিয়েছ–সব সত্যি; কিন্তু আগে বলো তো ভাই, এখানে তোমাদের কে আসতে বলেছে? শুধু জুলুদের উপকার করে উদার-হৃদয়ের পরিচয় দিতেই তোমাদের শুভাগমন হয়েছে, এমন কথা বিশ্বাস করার মতো মূর্খ আমরা নই। যা হয়ে গেল তার জন্য দেশের লোকের কাছে তোমরা খুবই অপ্রিয় হয়ে উঠবে। জুলুরা তোমাদের ভয় করবে, এড়িয়ে চলবে–কারণ, যেকোনো সময়ে তাদের গোপনীয় কথা তোমরা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস করে দিতে পার। আর এখন তো জুলুল্যান্ডে বৃষ্টি নেমেছে, কাজেই তৃণভোজী পশুরা আবার এখানে ফিরে আসবে এবং সিংহের দলও হামলা না-করে বুনো জানোয়ারের দিকে আকৃষ্ট হবে। অতএব, তোমরা আমাদের দেশ ছেড়ে চটপট বিদায় হও, জুলুরা তাদের ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানো পছন্দ করে না।
হ্যাঁ, অন্য কোনো নেতার পক্ষে ওই কথা বলাই স্বাভাবিক, কিন্তু জিপোসো হচ্ছে অসাধারণ মানুষ–অপ্রীতিকর বক্তব্যকে সে উপস্থিত করতে পারে সুন্দরভাবে। অনর্থক তিক্ততাকে পরিহার করতে ভালোভাবেই জানে সর্বাধিনায়ক জিপোসো।
অভিযাত্রীরা যে এখন পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করার কথা মুখেও আনেননি সেদিকে নজর না-দিয়ে সমবেত জনতাকে জিপোসো জানিয়ে দিল, বিদেশি আগন্তুকরা জুলুদের জন্য যথেষ্ট স্বার্থত্যাগ করেছেন–অতএব তারা দেশত্যাগ করার আগে দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা অবশ্য কর্তব্য। গোকে হত্যা করার অনুষ্ঠানে লিপ্ত হওয়ার জন্য অভিযুক্ত জুলু-যোদ্ধাদের আদেশ দেওয়া হল, তারা যেন প্রত্যেকেই গৃহনির্মিত কারুশিল্পের একটি করে নিদর্শন অভিযাত্রীদের উপহার দেয়–কারণ, পূর্বোক্ত এক-শো অভিযুক্ত যোদ্ধা আত্তিলিওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, অতএব উল্লিখিত উপহার জরিমানাস্বরূপ দিয়ে তারা বিদেশি অতিথির মার্জনা লাভ করতে পারবে। এইটুকু শাস্তি যথেষ্ট বলে মনে করল না জিপোসো; সে জানাল অভিযাত্রীদের জিনিসপত্র সসম্মানে গাড়িতে তুলে দিয়ে তাদের জুলুল্যান্ড পরিত্যাগ করার কাজে সাহায্য করতে হবে এবং ওই সাহায্যের ভার গ্রহণ করার জন্য পারিশ্রমিক দাবি করা চলবে না এ-কথাও জানিয়ে দিতে ভুলল না জিপোসো।
এমন চমৎকার বিচারের ফলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উৎসাহ বা আনন্দের লক্ষণ দেখা গেল না। ম্রিয়মাণ জনতাকে লক্ষ করে জিপোসো গর্জন করে উঠল, তোমাদের জন্য যেন মাসাংগাদের যাত্রা করতে দেরি না হয়ে যায়। কাল সকালেই ওঁরা দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, তোমাদের ত্রুটির ফলে যদি যাত্রা করতে দেরি হয়, তবে জরিমানার পরিমাণ হবে দ্বিগুণ! কথাটা যেন মনে থাকে!
এইবার ভাষণ দিতে উঠলেন আত্তিলিও। খুব সহজ সরলভাবে নির্বিকারমুখে তিনি জানালেন যে নেতা এমন সুন্দরভাবে বিচার করতে পারে এবং নির্বাক অতিথির মনোভাব বুঝতে পেরে তার ইচ্ছা পূরণের জন্য চেষ্টিত হয়, তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা তার নেই। তবে এমন একজন অধিনায়কের নেতৃত্ব লাভ করে সমগ্র জুলুজাতি যে ধন্য হয়েছে এ-বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ।