আত্তিলিও জানতেন সেটা সহজ নয়। জুলুরা তার গায়ে হাত দিতে সাহস করবে না। তবে টোয়াবেনি যে তাকে খুন করার চেষ্টা করবে সে-বিষয়ে আত্তিলিওর কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
সময় কাটতে লাগল ধীরে ধীরে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এগিয়ে আসতে লাগল গাছের ছায়া নির্দিষ্ট স্থানের দিকে। অবশেষে এল সেই চরম মুহূর্ত, আত্তিলিওর চিহ্নিত স্থানে উজ্জ্বল রোদের আলোকে লুপ্ত করে নামল অন্ধকারের প্রলেপ–
গাছের ছায়া এসে পড়েছে চিহ্নিত স্থানের উপর।
জুলুরা আকাশের দিকে মুখ তুলল–নির্মেঘ আকাশে জ্বলছে মধ্যাহ্ন সূর্য, বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনাই সেখানে দেখা যাচ্ছে না।
জনতার মধ্যে আবার জাগল হিংস্র উত্তেজনা। আবার শুরু হল উদ্দাম নৃত্য। এবার তারা দেরি করতে চায় না, কয়েকটা আসাগাই (বর্শা) গোর দেহে বিভিন্ন স্থানে আঘাত করল। ক্ষতচিহ্নগুলো খুবই তুচ্ছ ছিল বটে, কিন্তু আত্তিলিও জানতেন কিছুক্ষণের মধ্যেই আঘাতের বেগ জোরালো হয়ে উঠবে–রক্ত দেখে খেপে উঠবে.জুলুরা, সঙ্গেসঙ্গে মারাত্মক গম্ভীর হয়ে চেপে বসতে থাকবে বর্শাফলকের দংশন এবং এক সময়ে চমর আঘাতে নেমে আসবে মৃত্যু।
আত্তিলিওর সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত। তিনি বুঝেছেন আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোর মৃত্যু অবধারিত। তারপর তার পালা। টোয়াবেনির ইঙ্গিত পেলেই তারা যে আত্তিলিওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে-বিষয়ে আত্তিলিও ছিলেন নিসন্দেহ। তার একমাত্র ভরসা সর্বাধিনায়ক জিপোসো। কিন্তু জিপোসোকে যে এখানে নিয়ে আসতে পারে, সেই মদাবুলি এখন কোথায়? চতুর্দিকে ভ্রাম্যমাণ নরভুক সিংহদের নজর এড়িয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে জিপোসোর সঙ্গে দেখা করতে সমর্থ হয়েছে কি জুলুবালিকা?..
একটা বর্শার ফলা নগোর বুকে বিদ্ধ হল। হৃৎপিণ্ডের একটু উপরে। এগিয়ে এল আর একটা বর্শা। আত্তিলিও বুঝলেন চরম আঘাত পড়ার সময় এগিয়ে আসছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করবে গো। আর তারপরেই যে রক্তাক্ত বর্শাফলকগুলো নেচে উঠবে তার চারপাশে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আত্তিলিও সেই দুরবস্থার কথা কল্পনা করে চমকে উঠলেন–গোর মতো নির্বিকার মুখে অবিচলিতভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার সাধ্য তার নেই…
আত্তিলিও নিজের শ্রবণশক্তিকে বিশ্বাস করতে পারলেন না–গোর নাম ধরে কে যেন ডাকছে!
কিন্তু না, ভুল হয়নি–উপত্যকার তলা থেকে নারীকন্ঠের চিৎকার ভেসে এল আবার, নগো! গো!
আত্তিলিও দেখলেন পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে ছুটে আসছে মদাবুলি। পাহাড়ের অপর প্রান্তে যেখানে আত্তিলিও সাহেব রাইফেল রেখে এসেছিলেন সেখানেও আবির্ভূত হয়েছে অনেকগুলো বর্শাধারী মনুষ্যমূর্তি! সর্দার জিপোসো এসে পড়েছে সসৈন্যে।
জনতা সচমকে ফিরে দাঁড়াল, তারপর প্রাণপণে ছুটে পালাতে চেষ্টা করল। কেউ পালাতে পারল না, জিপোসোর সৈন্যরা প্রত্যেকটি মানুষকেই বন্দি করে ফেলল।
মদাবুলি ছুটতে ছুটতে এসে আত্তিলিওর সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
আত্তিলিও বলে উঠলেন, ভয় নেই, গো বেঁচে আছে।
হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তর দিল মদাবুলি, তুমি–তুমিও বেঁচে আছ?
ঠিক দুদিন পরেই বৃষ্টি নামল জুলুল্যান্ডে।
.
একাদশ পরিচ্ছেদ – সর্বাধিনায়ক জিপোসো
আহত গো আরোগ্য লাভ করার সঙ্গেসঙ্গেই জিপোসোর আস্তানাতে বিচারসভা বসল। বলাই বাহুল্য বিচারক ছিল জুলুদের সর্বাধিনায়ক জিপোসা।
বিচারের ফলাফল দেখে আত্তিলিও বুঝলেন জুলুদের নেতা অসাধারণ তার দূরদর্শিতা, রাজনীতিজ্ঞান ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি অতুলনীয়।
ইনডানা বা জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সম্বন্ধে কোনো আলোচনা উঠল না। সর্বাধিনায়ক শুধু বলল, উক্ত জ্ঞানী ব্যাক্তিদের জিহ্বা সম্বন্ধে সংযত হওয়া উচিত এবং যেহেতু তারা মূখের মতো কথা বলে এক অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, সেইজন্যে কয়েক দিন সম্পূর্ণ মৌন থেকে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
গন্ধের বিচারে যে যোদ্ধার দল অংশগ্রহণ করেছিল, তারা রেহাই পেল না। আদালতের রায় অনুসারে প্রত্যেক যোদ্ধাদের উপর জরিমানা ধার্য হল–উত্তমরূপে প্রস্তুত একটি আসাগাই (বর্শা), তিনটি বাছুর ও তিনটি ছাগল। জন্তুগুলো যেমন তেমন হলে চলবে না, দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সেরা জন্তুগুলোকেই দাবি করেছে আদালত।
সাধারণ যোদ্ধাদের চার গুণ বেশি জরিমানা ধার্য হল সুকামবানার উপর। জরিমানার ফলে যে পশু আদায় করা হল, সেই জন্তুগুলোর মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ গোকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেওয়া হল। অবশিষ্ট অংশ গ্রহণ করল সর্দার জিপোসো, আদালতের ব্যয়নির্বাহ করার জন্যে ।
টোয়াবেনিকে নিজের হাতে শাস্তি দিল না জিপোসো। ওই শয়তান জাদুকরের কুকীর্তির বিশদ বিবরণসহ তাকে প্রেরণ করা হল ইশোয়ি নামক স্থানের ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। শ্বেতাঙ্গদের বিচারে টোয়াবেনির যে কী দুরবস্থা হবে সে-বিষয়ে জিপোসো ছিল দস্তুরমতো সচেতন।
নিজের হাতে দণ্ডবিধান করে জুলুদের সমালোচনার বিষয়বস্তু হতে চায়নি বলেই সাদা মানুষদের হাতে টোয়াবেনির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল সর্দার জিপোসো। অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত এক রক্ষীবাহিনী টোয়াবেনিকে নিয়ে রওনা হল উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে।
জুলুদের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে পরিবারের কর্তা মারা গেলে বা অক্ষম হলে ওই পরিবারের সব দায়িত্বই সর্দারকে বহন করতে হয়। টোয়াবেনির পরিবারভুক্ত মানুষগুলোর জন্য খুব ভালো ব্যবস্থাই করেছিল জিপোসো।